ভাবসম্প্রসারণ |Bhabsomprosaron

যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ বাতি


মূলভাব : মনের ক্ষণস্থায়ী আনন্দের জন্য বিলাসিতা করে অর্থ-সম্পদ অপচয় করা উচিত নয়। অপচয় না করলে সাধারণত অভাবও হয় না। অপরের সাহায্য ছাড়াই দুর্দিনে দারিদ্র্যের মোকাবিলা করা যায়

 

সম্প্রসারিত ভাব : মানুষের অর্থ-সম্পদ সীমিত। আর সীমিত অর্থ-সম্পদ দিয়ে আমাদের অসীম অভাব পূরণ করতে হয়। যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় অভাব। এসব অভাব দূর করতে না পারলে আমাদের জীবন চলতে পারে না। আবার কিছু অভাব আছে যেগুলো পূরণ না করেও আমরা চলতে পারি। যেমন বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, এসি, দামি পোশাক, দামি অলঙ্কার ইত্যাদি। কিন্তু যখন অর্থ-সম্পদ থাকে, তখন মানুষ ভবিষ্যতের চিন্তা না করে অপচয় করে। বিলাসিতা করে দিন কাটায়। বিলাসবহুল নিত্য নতুন জিনিসপত্র ক্রয় করে নিজের অর্থ-সম্পদ প্রদর্শনের জন্য। কিন্তু মানুষের জীবন সুখ সাফল্যে শেষ নাও হতে পারে। জীবনে নেমে আসতে পারে দারিদ্র্য, ব্যর্থতা। তখন সঞ্চিত অর্থ দিয়ে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি খোঁজা যায়। কিন্তু যদি কেউ সব অর্থ-সম্পদ বিলাসিতা করে নষ্ট করে তাহলে একদিন তাকে দিশেহারা হয়ে যেতে হয়। যে কিনা সারাজীবন বিলাস-বহুল জিনিসের পেছনে ছুটেছে, সে জীবনধারনের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর অভাব মেটাতে ব্যর্থ হবে। তার জীবনে নেমে আসবে কেবল অভাব এবং দারিদ্র্য। বুদ্ধিমান সঞ্চয়ী মানুষ নিজের এবং পরিবারের কল্যাণে খারাপ সময় মোকাবিলার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সঞ্চিত রাখে

 

 

" কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
ভাই বলে ডাক যদি দেব গলা টিপে,
হেন কালে আকাশেতে উঠিলেন চাঁদা,
কেরোসিন শিখা বলে- “এসো মোর দাদা।

 

মূলভাব : বিত্তশালী মানুষদের প্রতি অনুরাগ এবং নিজের থেকে বিত্তহীন স্তরের মানুষদের প্রতি অবজ্ঞা, মানবসমাজের এক শ্রেণির মানুষের দুর্বল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

সম্প্রসারিত ভাব : পৃথিবীতে মানব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য রহস্যময়। আমাদের এই সমাজে মানুষ সবসময় চেষ্টা করে সমাজের ওপরের স্তরের মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তা স্হাপন করতে।নিজেদের নীচের তলার মানুষের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না আত্মীয় হলেও তাকে উপেক্ষা করে চলে। মূলত মানুষ নিজের চেয়ে অবস্থানে ছোটোদের চরমভাবে অস্বীকার করে, আর বড়োদের তোষামদ করে আপন করে নিতে চায়। পদমর্যাদা সামাজিক অবস্থান মানুষকে অন্ধ করে দেয়। এর প্রলোভনে মানুষ নিজের আপন মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়ে, দূরের মানুষকে আপন করার চেষ্টা করে। এতে করে সে তার নিজস্বতাকে হারিয়ে ফেলে, কিছুই অর্জন করতে পারে না

প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই প্রকৃতিতে আমরা আলো এবং অন্ধকারের উপস্থিতি দেখতে পাই। প্রতিনিয়ত যথা সময়ে দিনের শেষে পৃথিবী অন্ধকারের কালো চাঁদরে ঢেকে যায়। রাতের আঁধার কাটলে সকালে পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ আবার সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়। প্রাকৃতিক নিয়মেই এমনটা ঘটে। দিনের স্নিগ্ধতা আর রাতের কোমলতা এসব কিছুকে সৃষ্টিকর্তার অফুরন্ত নিয়ামত হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সুন্দর এই পৃথিবীতে পরস্পর বিপরীতধর্মী বিষয় বস্তুসমূহের মধ্যে তীব্র আকর্ষণ বিরাজ করে। এসব উপাদানের দ্বান্দ্বিক পালা বদল প্রক্রিয়া সর্বদা সচল এবং অস্তিত্বমান। জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি-ধ্বংস, আলো-আঁধার, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ এসব কিছুই পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, যদিও বৈশিষ্ট্যগতভাবে এরা একে অপরের বিপরীত। সৃষ্টির প্রতিটি জীবের কাছে নিজের জীবন অমূল্য সম্পদ। জন্মের পর মৃত্যু অবধারিত বলেই বেঁচে থাকাটা এত মধুর।  মানুষ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে শুধুমাত্র তখনই সুস্থতার গুরুত্ব বুঝতে পারে। সেজন্যেই মানুষ তার সুস্বাস্থ্য রক্ষা করতে চায়। সুখ-দুঃখও তেমন বিপরীতধর্মী উপাদান বলে একে অপরের পরিপূরক। দুঃখ মানুষের মনকে যদি ব্যথিত করতে না পারতো তাহলে মানুষ সুখ আনন্দবোধের মর্ম বুঝতে পারতো না। সুখ লাভের আশায় মানুষ দুঃখ-কষ্টকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করতে রাজি হয়। ঠিক একইভাবে প্রকৃতিতে অন্ধকারের উপস্থিতি আছে বলেই আলো এত মহিমাময়। অন্ধকার না থাকলে আলোর গৌরব এবং দীপ্তি এসব কিছুই ম্লান হয়ে যেত

 

" ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি "

 

মূলভাব : ক্ষুধার অনুভূতি তীব্র প্রচণ্ড। দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাত মানুষের দৃষ্টি হৃদয় থেকে রূপ-সৌন্দর্য প্রেমের নান্দনিক বোধগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। তাই ক্ষুধার নিবৃত্তি অত্যাবশ্যক

সম্প্রসারিত ভাব : মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সৌন্দর্যপ্রিয়, রূপপিয়াসী, কল্পনাবিলাসী। কল্পনার জগতে বিরাজ করতে করতে মন হারিয়ে যায় সুদূরে। বাঁশির সুর মনকে উদাস করে দেয়। বৃষ্টির রিমঝিম ধ্বনি অন্তরকে টেনে নিয়ে যায় দূরে, প্রিয়জনের সান্নিধ্যে। সবই মন হরিণীর লীলাখেলা। এগুলো মনকে তৃপ্ত করে, হৃদয়কে শান্ত করেপেট ভরা থাকলে চাঁদের হাসি আনন্দের বাঁধ ভেঙে দেয়, ফুলের সুবাস মাতোয়ারা করে হৃদয়, রঙের খেলা নানা রঙে রাঙিয়ে তোলে অন্তর। কিন্তু পেটে যদি খাবার না থাকে তাহলে পৃথিবীটাকে মনে হয় নিরস-গদ্যময়। ক্ষুধার তীব্রতায় যে কোনো গোলাকার জিনিসকে মনে হয় ঝলসানো রুটি। অর্থাৎ ক্ষুধাই সেখানে মুখ্য, অন্য সবকিছুই গৌণ, তুচ্ছ, গুরুত্বহীন। তাই ক্ষুধিতের কাছে পুর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি হিসেবে ধরা দেয়। চাঁদের সৌন্দর্যে ক্ষুধিত কিছুমাত্র আকর্ষণ বোধ করে না। জীবনের সব ভালোলাগা, সব রূপ, সব ছন্দ হারিয়ে যায়। সময় জীবন হয়ে ওঠে বিবর্ণ, শুষ্ক, ধুলিধূসর।
সভ্যতার উৎকর্ষের যুগেও পৃথিবীর চল্লিশ শতাংশ মানুষ এখনও মানবেতর জীবন যাপন করে। তাদের চারপাশে কেবল অভাব-অনটন, ক্ষুধা-তৃষ্ণা সমস্যার পাহাড়। কষ্ট আর যন্ত্রণায় তাদের মন থেকে রূপ-সৌন্দর্যবোধ হারিয়ে গেছে।মানব জীবনের প্রথম চাহিদা ক্ষুধার নিবৃত্তি। তা দুষ্প্রাপ্য হলে কাব্যের ছন্দ, অলংকার, উপমা পানসে হয়ে যায়। পূর্ণিমার চাঁদকে মনে হয় ঝলসানো রুটি। তাই মানব জীবনে ক্ষুধা নিবৃত্তির সাধনাই হোক আমাদের প্রথম সাধনা

 

প্রাচীরের ছিদ্রে এক নাম গোত্র হীন  ফুটিয়াছে ফুল এক অতিশয় দীন।
ধিক্ ধিক্ বলে তারে কাননে সবাই,
সূর্য উঠি বলে তারে ভালো আছো ভাই?

 

মূলভাব : ক্ষুদ্রের গৌরব ক্ষুদ্র মানুষেরা স্বীকার করে না।করেন মহৎ ব্যক্তিরা। প্রাচীরের ছিদ্রে ফোটা এক নাম গোত্রহীন ফুলকে বাগানের ফুলেরা স্বীকার না করলেও, তাকে স্বীকৃতি জানায় স্বয়ং সূর্য।এখানেই প্রকৃত মহত্ত্বের পরিচয়

সম্প্রসারিত ভাব : নিজ জন্মের ওপর মানুষের কোনো হাত নেই। সে সমাজের একেবারে নিম্ন স্তরে জন্মগ্রহণ করতে পারে আবার সমাজের উঁচু স্তরেও জন্ম গ্রহণ করতে পারে। তেমনি ভাঙ্গা প্রাচীরের গায়ে এক অখ্যাত ফুল ফুটেছে যার আকার ছোট, রঙের কোনো বাহার নেই, নেই কোনো গন্ধ, নেই শোভা। তার স্বজাতি ফুলগুলোও তাকে পরিচয় দিতে নারাজ। এমন কি সে ছোট বলে তার কোনো নাম নেই বলে তাকে ধিক্কার জানাতে দ্বিধাবোধ করে না। কিন্তু সেই অবহেলিত ফুলকে সূর্য প্রতিদিন সম্মান জানিয়ে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছে। আমাদের সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা ধন সম্পদের অঢেল মালিক, তাদেরকে সবাই শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে। অথচ তারাই সমাজের নিরীহ গরিবদের মানুষ হিসেবে মনে করে না। কিন্তু তারা ভাবে না যে সমাজের সে স্তর থেকেও যে তারা বড়ো কিছু হতে পারে। তারপরও সমাজে সব মানুষ সমান নয়। যারা প্রকৃত মহৎ এবং উদার তাদের মন সবসময় সুন্দরের আলোয় আলোকিত। তাদের চোখে সমাজে ছোট বড় বলে কিছুই নেই। সকলকেই তারা সমানভাবে মূল্যায়ন করে। সূর্যের মতোই তাঁরা মহৎ এবং উদার। সূর্য যেমন অখ্যাত ফুলকে সবসময় কুশল জানায় তেমনি সমাজের মহৎ ব্যক্তিবর্গ নিরীহ গরিবদের পাশে থাকে। তাদের যেকোনো প্রয়োজনে মহৎ ব্যক্তিগণ এগিয়ে আসেন। এই উদারতার আলোকেই তারা সমাজের সবাইকে সমানভাবে মর্যাদা দিয়ে থাকেন। সমাজে যাঁরা প্রকৃত উদার মনের অধিকারী তারা ধনী-গরিব সবাইকে সমানভাবে মূল্যায়ন করেন। কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরন থেকে তারা বিরত থাকে

 

বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে

 

মূলভাব : নিজের নিজের পরিবেশে সব কিছুই সুন্দর মাতৃক্রোড়ে শিশুকে এবং বন্যপশুকে বনে দেখতেই ভালো। পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেই তা অসুন্দর এবং বিসদৃশ

সম্প্রসারিত ভাব : প্রত্যেক প্রাণীই একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে জন্ম গ্রহণ করে। সেই পরিবেশেই সে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। আপন পরিবেশের সাথে তার এক ধরণের সম্পর্ক গড়ে উঠে সেখানেই তাকে সবচেয়ে ভালো মানায়। প্রতিটি প্রাণীই আপন পরিবেশ ছাড়া চলতে পারে না। বন্য প্রাণীর জন্য সুন্দর স্থান হলো বনভূমি। বন্য প্রাণীরা মানুষের সাথে বসবাস করতে পারবে না। নিজস্ব পরিবেশই তাদের সুখ দিতে পারে। বনের পাখিদের বৈশিষ্ট্য হলো আকাশে উড়ে বেড়ানো। সেই পাখিকে দামী খাঁচায় ভরে রাখলেও সে আনন্দ পাবে না। আবার শিশুদের জন্য মায়ের কোলই হলো উপযুক্ত স্থান। মায়ের কোল ছাড়া অন্য কারো কোলে রাখলে সে তৃপ্তি পায় না।  জলের পরিবেশেই মাছের বৃদ্ধি, জল থেকে ডাঙ্গায় তুললে মাছ মরে যায়। এভাবে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই নিজস্ব বাসস্থান ব্যতীত স্বাধীনভাবে চলতে পারে না। পৃথিবীকে সুন্দরভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রতিটি প্রাণীর আপন আপন পরিবেশের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান এবং প্রতিটি প্রাণী পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে অনেক সুন্দর জিনিসও অসুন্দর হয়ে যায়। তাই প্রতিটি প্রাণীকে তার নিজ নিজ পরিবেশে বিকাশের সুযোগ দেওয়া উচিত

 

বৈরাগ্য-সাধনে মুক্তি, সে আমার নয় অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ

 

মূলভাব : মানুষ সামাজিক জীব সংসার ত্যাগ করে মানুষ কখনও সুখী হতে পারে না সমাজ সংসারের সকলকে নিয়েই মানুষকে সুখী হতে হয়

সম্প্রসারিত ভাব : সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না নিয়েই মানুষের জীবন। একজন মানুষের সাফল্য তখনই আনন্দদায়ক হয় যখন তাতে সকলের অংশগ্রহণ থাকে। পৃথিবীতে কেউই পরিপূর্ণভাবে সুখী হতে পারে না। জীবনে চলার পথে অনেক বাধা  আসতে পারে। তাই বলে ভেঙ্গে পড়া উচিত নয়। সমাজে এক শ্রেণির মানুষ আছে যার দুঃখ-কষ্টকে ভয় পায়। তারা মনে করে সংসার হল একটি বিষাদময় স্থান। সংসারের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার উত্তম উপায় হল সংসার ধর্ম ত্যাগ করা। কিন্তু বৈরাগ্য সাধন করলেই মুক্তি মেলে না। কোনো কিছুই সহজে পাওয়া যায় না। মানুষ তা জানলেও বুঝতে চায় না। সুখ-দুঃখ একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ মাত্র। কষ্টের পরই সুখ আসে যে সুখ বিনাকষ্টে অর্জিত হয় তা স্থায়ী হয় না।  সংসারের সকলের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়ার মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃত মুক্তির স্বাদ উপলব্ধি করে। অন্যদিকে দুঃখ-কষ্ট থেকে বাঁচতে যারা সংসার ত্যাগ করে তারা কখনো মুক্তির সন্ধান পায় না

 

যত বড় হোক ইন্দ্রধনু
সে সুদূর আকাশে আঁকা
আমি ভালবাসি মোর ধরণীর প্রজাপতিটির পাখা

 

মূলভাবঅধরা কিছু পাওয়ার দুরাশা না করে হাতের কাছে যা আছে তা নিয়েই খুশি থাকা উত্তম। কারণ বাস্তব আর কল্পনার মাঝে রয়েছে বিশাল ব্যবধান। তাই প্রতিটি মানুষেরই উচিত আকাশ কুসুম কল্পনা না করে, সাধ সাধ্যের মধ্যে সংগতি বজায় রেখে পথ চলা

সম্প্রসারিত ভাব : মানুষ রূপ বৈচিত্র্যে ভরা মাটির পৃথিবীর সন্তান। প্রকৃতির নদী-নালা, লতা-পাতা, ফুল-ফল, পাখি এসব নিয়েই তার পরিবেশ। এখানেই তার অভ্যস্ত জীবনযাত্রা অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলছে। কিন্তু মানুষ স্বপ্ন বিলাসীও। অধরার সৌন্দর্যকে নিয়ে তার কল্পনা-বিলাসের অন্ত নেই। দূরের আকাশে সাতরঙের বিচিত্র ছটায় ইন্দ্রধনু দেখা যায়। তার সৌন্দর্য মানুষের স্বপ্নচারী মনকে হাতছানি দেয়। কিন্তু যা ধরা- ছোঁয়ার বাইরে তা যত বড়ো বা যত সুন্দরই হোক না তা মানুষের স্পর্শের বাইরে। তার চেয়ে আকর্ষণীয় প্রতিদিনের এই চিরপরিচিত ধূলিমাখা পৃথিবী। কারণ অনেক দূরের বস্তু যতই মনোমুগ্ধকর হোক না কেন, বাস্তবজীবনের সাথে তার কোনো যোগ নেই। তাকে কখনোই আপন করে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে, ছোট প্রজাপতি তার বিচিত্র রঙের পাখা নিযে মানুষের চার পাশে উড়ে বেড়ায়। মানুষ সহজেই খুব কাছ থেকে তার সৌন্দর্য উপভোগ করে। মনে হয় অপরূপ সৌন্দর্যের আধার এই প্রজাপতি। তাই মানুষ দূরের রংধনুর সৌন্দর্যের চেয়ে প্রজাপতির সৌন্দর্যে বেশি মুগ্ধ হয়, ভালোবাসে সে তার গৃহের নিকটে ফুটে থাকা নানান বর্ণের ফুল, ভোরের শিশির বিন্দু আর পাখির কলকাকলি। যেন প্রকৃতি-জননীর নিজের হাতে সাজিয়ে রাখা অন্তহীন সৌন্দর্য। প্রকৃত সৌন্দর্য প্রেমিকরা অলীক সৌন্দর্যের মিথ্যা মায়ায় ডুবে থাকে না। বরং ভালোবাসে চারপাশের বিশ্ব প্রকৃতির সৌন্দর্যকে। আর তারাই তো সৌন্দর্যের সত্যিকার সাধক

 

 

সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে

মূলভাব : কেবল নিজের স্বার্থরক্ষাই মানব জীবনের লক্ষ্য নয়। পরস্পর পরস্পরের কল্যাণে উপকারের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতা। পারস্পরিক সহযোগিতা সহমর্মিতাই মানব জাতির সমাজ বন্ধনের ভিত্তি। পথেই মানুষ পায় বাঁচার আনন্দ, অর্জন করে জীবনের সার্থকতা

সম্প্রসারিত ভাব : প্রাণীজগতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ- মানুষ কেবল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত নয়। অন্যান্য প্রাণীর মতো কেবল নিজের প্রাণ বংশ রক্ষাতেই সে ব্যাপৃত থাকে না, সমাজ-সভ্যতার অগ্রগতিতেও তাকে ভূমিকা রাখতে হয়। তার জীবন সমাজের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা। সমাজ জীবনই ব্যক্তিমানুষের জীবনকে নিশ্চিন্ত, নিরাপদ, সুগম উন্নয়নমুখী করার নিশ্চয়তা দেয়। তাই সমাজবদ্ধ প্রতিটি মানুষ যদি সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্যে নিজ নিজ সামর্থ্য যোগ্যতা অনুসারে মেধা শ্রম না দেয় তবে সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত হয় এবং তা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির জীবনেও সংকট বয়ে আনে। সমাজে অবশ্য এমন কিছু আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর লোক আছেন যাঁরা বৃহত্তর সমাজের কাছে তাঁদের অপরিসীম ঋণের কথা ভুলে যান। সমাজ যে মানুষের নিরাপত্তা, শান্তি-শৃঙ্খলা, সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে, বিপদে-আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় সত্য তাঁদের মনে থাকে না। এঁদের ধরনের স্বার্থান্ধ মনোবৃত্তি সমাজের স্বার্থের বিরোধী। এঁরা কেবল যে সমাজের প্রতি দায়িত্বের কথা ভূলে যায় তা নয়, সমাজ বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়ে। এঁদের জীবন অনেকটা গুটি বা খোলসের ভেতরে আবদ্ধ রেশম পোকার জীবনের মতোই বৃত্তবদ্ধ। জীবন টিকে থাকর মতো জীবন, বাঁচার মতো বাঁচা নয়। বস্তুত মানুষ সবার সঙ্গে সবার মধ্যে সবার জন্যে বাঁচে। সে বাঁচাই যথার্থ বাঁচা। যে সমাজ মানুষকে দেয় অনেক সেই সাজের জন্যে কিছু করতে পারলে জীবন কেবল সার্থক হয় না, পরের কল্যাণে আত্মত্যাগের অপরিসীম আনন্দে জীবন স্নিগ্ধ হয়। পরস্পরের মঙ্গলের চেষ্টাতেই সমাজের কল্যাণ হয়, মানুষের জীবন হয় সার্থক

 

অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে

 

সুন্দর সমাজ গড়ার জন্য এবং সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মানুষ গড়ে তুলেছে অনুশাসন এবং ন্যায়-নীতির মানদন্ড। কিন্তু কিছু মানুষ রয়েছে যারা এসব ন্যায়-নীতি অমান্য করে অন্যায় অবৈধ কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হয়। এরা সমাজের চোখে অন্যায়কারী এবং আইনের চোখে অপরাধী হিসাবে বিবেচিত। আবার যারা অন্যায়ের প্রতিবিধান বা বিরুদ্ধাচরণ করে না বরং শৈথিল্যের সাথে তা মেনে নেয়, সূক্ষ্ম বিচারে তারাও অপরাধী। কারণ অন্যায়ের বিচার না করলে তা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। আমরা জানি ক্ষমা একটি মহৎ গুণ। হিসাবে অপরাধীকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা যেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে এমনটি মনে হলেও মনে রাখা দরকার যে, ক্ষমারও নির্দিষ্ট সীমা থাকতে হবে। তা না হলে অন্যায় বেড়ে গিয়ে সমাজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। বিবেকবান মানুষ হিসাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার চেতনার অধিকারী হলেও অনেক সময় মানুষ নানা কারণে দিনের পর দিন অন্যায়কে সহ্য করে। সরাসরি অন্যায় না হলেও এটি অন্যায়কে সহযোগিতা করার নামান্তর। অনেকে বিপদের ঝুঁকি থাকায় নীরবে অন্যায়কে সহ্য করে চলে। এসব প্রবণতার কারণে আজ আমাদের সমাজে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহ্যকারী উভয়ই সম অপরাধে অপরাধী

কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে?

মূলভাব : জীবনে চলার পথে বাধা বিঘ্নকে ভয় করে পিছিয়ে পড়লে জীবনে সফলতা অর্জন করা যায় না। জীবনকে সাফল্যমন্ডিত করতে হলে সকল দুঃখ-কষ্ট, বাধা-বিঘ্ন জয় করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ কষ্টের মাধ্যমে অর্জিত সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়

দুঃখকে বাদ দিয়ে জীবনে সুখের আশা করা যায় না। পদ্মকে তুলতে গিয়ে কাঁটার ভয় করলে চলবে না। কাঁটার ভয়ে বা কাঁটার আঘাতে যদি কেউ পদ্ম তুলতে না যায়, তাহলে তার পক্ষে পদ্ম আহরণ সম্ভব হবে না। তেমনি একটিকে চাইতে গেলে অপরটিকে মেনে নিতে হয়। ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ জয়-পরাজয় ইত্যাদি নিয়েই আমাদের জীবন। একটি অপরটির পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। দুঃখকে বাদ দিলে জীবনে সুখের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। দুঃখের মধ্য দিয়েই জীবনে সুখের আস্বাদ লাভ করা যায়। দুঃখের ভয়ে যে তার নিজ কর্ম থেকে বিরত থাকে তার পক্ষে সুখ লাভ করা সম্ভব নয়। সফলতার পথ কণ্টকাকীর্ণ। এই কাঁটার ভয়ে যে সেই পথে হাঁটে না সে কখনো সফল হয় না। দুঃখ-যন্ত্রণা, পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষ তার গন্তব্যে পৌঁছায়। আর যারা দুঃখ-যন্ত্রণা, ক্লান্তির ভয়ে ভীত হয় তারা সহজেই ঝরে পড়ে সাফল্যের পথ থেকে। তাই সকল প্রতিকূলতাকে বরণ করেই মানুষকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। পৃথিবীতে যাঁরা বড় হয়েছেন, সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছেন তাঁরা সবাই সাধনার দ্বারা দুঃখ-কষ্ট, বাধা-বিঘ্নকে অতিক্রম করেই হয়েছেন। পরাজয়ের গ্লানি, পরিশ্রমের কষ্টকে জয় করার মাধ্যমেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন- “ব্যর্থতাই মানুষের জীবনের প্রথম সাফল্য।

 

শৈবাল দীঘিরে বলে উচ্চ করি শির
লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির

 

মূলভাব : মহৎ তারাই যারা মিথ্যে বাহাদুরির আশ্রয় নেন না। পরের কল্যাণ সাধনেই তাদের সুখ। আর অকৃতজ্ঞ ব্যক্তি সমাজের কাছে সব সময়ই মূল্যহীন। তারা কখনোই সমাজে বড় কিছু হতে পারে না

সম্প্রসারিত ভাব : মহৎ মানুষ হিংসা, দীনতা, হীনতা স্বার্থপরতা থেকে নিজেকে দূরে রাখেন। উদার, মানব প্রেমিক এসব মানুষ সর্বদা সকল মানুষের মঙ্গল চিন্তা করেন। তাদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা কর্ম দিয়ে দেশ জাতির কল্যাণসাধন করেন। তারা কখনো আপন গৌরবের কথা, উপকারের কথা অন্যের কাছে গর্ব করে প্রচার করেন না। সমাজের মানুষকে তারা বটবৃক্ষ হয়ে আগলে রাখেন। তারা নিঃস্বার্থভাবে অপরের জন্য কাজ করে যান। বিপরীতে আমাদের সমাজে কিছু হীন, স্বার্থপর মানুষ আছে যারা সর্বক্ষণ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অন্যের উপকারের কথা স্বীকার করতে চায় না। বরং কখনো যদি উপকারীর সামান্যতম উপকার করতে পারে, তবে তা অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে। তারা কখনোই বুঝতে চেষ্টা করে না যে তারা কতটা ক্ষুদ্রমনা। এই অকৃতজ্ঞতাবোধের পরিচয় পাওয়া যায় শৈবালের জীবনে। শৈবালের জন্ম দীঘির জলে, দীঘির জলেই তার অবস্থান। দীঘি তাকে পরম মমতায় তার জলে স্থান দেয়। সেই জলেই শৈবালের বেড়ে ওঠা। শৈবালের উচিত দীঘির প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। কিন্তু তা না করে মিথ্যে বাহাদুরি দেখায়। কেননা, শৈবালের ডগায় রাতের শিশির বিন্দু জমে। এক সময় তা দীঘির জলে পড়ে। অকৃতজ্ঞ শৈবাল তখন অহংকার করে এই বলে যে, সে দীঘিকে এক ফোঁটা জল দিয়েছে। তার এই এক ফোঁটা জল নিতান্তই তুচ্ছ যা দীঘির তেমন কোনো উপকারে আসে না। বরং এতে শৈবালের হীনমন্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। আমাদের সমাজের অকৃতজ্ঞ মানুষগুলোও শৈবালের মতোই

 

ভাবসম্প্রসারন: পৃথিবী অলস ভীরু কাপুরুষদের জন্য নয়

মূলভাব : পৃথিবীতে তারাই টিকে থাকে, যারা পরিশ্রমী, সাহসী, উদ্যমী এবং সংগ্রাম করে সব প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারে

ভাব-সম্প্রসারণ : পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী বস্তু কণাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। একখণ্ড পাথর পৃথিবীর একটু অবস্থান হয়তাে দখল করে আছে। তাকে সরাতে চাইলে সে সহজে নড়ে না। প্রাণপণে আঁকড়ে থাকে স্থানটুকুতে। যতক্ষণ পর্যন্ত তার চেয়ে অধিক শক্তি প্রয়ােগ করা না যায় ততক্ষণ সে সেই স্থান ছাড়ে না। একটি তৃণলতা মাটি আঁকড়ে ধরে টিকে থাকে। তাকে উপড়ে ফেলতে চাইলে সে প্রাণপণে মাটিকে কামড়ে ধরে। যতক্ষণ তার চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়ােগ করা না হয়, ততক্ষণ সে উঠে আসে না। হচ্ছে টিকে থাকার সংগ্রাম। মানবসমাজে সংগ্রামের রূপ আরাে তীব্র প্রতিযােগিতাপূর্ণ। এখানে জন্মের পর থেকে প্রতিটি মানুষকে টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়। পরিশ্রম ছাড়া পৃথিবীতে কোনাে কিছুই লাভ করা যায় না। আজকের মানব সভ্যতার যে উন্নতি, এর মূলে রয়েছে মানুষের নিরলস কর্ম প্রচেষ্টা, সাধনা নিরন্তর পরিশ্রম। যারা পরিশ্রম করতে জানে, তারাই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে। আজকে আমরা যাদেরকে সমাজের, জাতির বা বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে দেখি তাদের এই শীর্ষস্থানে উঠে আসার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে পরিশ্রম। তারা দুর্জয় সাহসে, নির্ভিকচিত্তে সংগ্রাম করেছে, প্রতিকূলতাকে জয় করেছে। ফলে আজ তারা বিশ্বের চালিকা শক্তি হতে পেরেছে। ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা একই চিত্র দেখতে পাই। পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁদেরই নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে- যারা দুর্জয় সাহসে জীবন-মরণ পণ করে কর্মক্ষেত্রে ঝাপিয়ে পড়েছে এবং সব বাধা-বিপত্তিকে পায়ে দলে সাফল্যকে ছিনিয়ে এনেছে। যেমন : আলেকজান্ডার বা নেপােলিয়নের মতাে বীরযােদ্ধা, এরিস্টটল, সক্রেটিস, প্লেটোর মতাে মহাজ্ঞানী, হযরত মুহম্মদ ()-এর মতাে মানব মুক্তির দিশারি, শেক্সপীয়র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতাে কবি-সাহিত্যিক প্রমুখ। আজকে তারা প্রতিটি মানুষের কাছে স্মরণীয় বরণীয়। ইতিহাস তাঁদেরকে কখনাে ভুলে যাবে না। কিন্তু যারা অলস, ভীরু, কাপুরুষ, তারা কোনােভাবেই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবে না। পৃথিবী তাদের জন্য নয়। অলসরা জীবনে কোনােকিছুই করতে পারে না। তারা সবসময় থাকে নির্ভরশীল। আর যারা ভীরু, কাপুরুষ তারা তাে মরার আগেই মরে থাকে। নতুন পথে পা বাড়ানাে তাে দূরের কথা, প্রচলিত পথেই তারা পা বাড়ানাের সাহস পায়। ফলে জীবনে তারা কোনাে কিছুই অর্জন করতে পারে না। তারা খুব দ্রুত হারিয়ে যায়। মানুষ তাদেরকে মনে রাখে না। পৃথিবীর ইতিহাসে তাদের নামের ছায়াটুকুও থাকে না কারণ টিকে থাকতে হলে প্রয়ােজন পরিশ্রম সাহস। পৃথিবী অলস, ভীরু কাপুরুষদের জন্য নয়

মন্তব্য: পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে চাই কঠোর পরিশ্রম সাহসী সাধনা। কিন্তু ভীরু, অলস, কাপুরুষদের দ্বারা তা সমভব হয় না। আর সেজন্যই বলা হয় যে, পৃথিবী অলস ভীরু কাপুরুষদের জন্য নয়

 

আলাে বলে, “অন্ধকার, তুই বড় কালাে”। অন্ধকার বলে, “ভাই, তাই তুমি আলাে।”

মূলভাব : আলাে-আঁধার, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না এসব পরপর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এদের একটি ছাড়া যেমন অন্যটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, তেমনি তার সার্থকতাও আশা করা অনুচিত। এ বৈপরীত্য নিয়েই জীবন।

ভাব-সম্প্রসারণ : আমাদের এ সুন্দর পৃথিবীতে পরস্পর বিপরীতধর্মী উপাদানসমূহের প্রক্রিয়া সচল । মূলত বৈচিত্র্যের অপূর্ব সমাবেশেই জীবন ও জগৎ গড়ে উঠেছে। দুঃখ আছে বলেই সুখ এমন মহিমান্বিত, আর সুখ আছে বলেই মানুষ দুঃখকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। জন্মের পর মৃত্যু অবধারিত বলেই জীবনকে বলা হয় মহামূল্যবান । অন্ধকার এসে দিবালােক গ্রাস করে বলেই পরদিন প্রভাতের সােনালি সূর্যোদয় চিত্তকে হরণ করে ।

আঁধার আছে বলেই আলাে বৈচিত্র্যময়, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। অতৃপ্তি না থাকলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন হতাে না। মহৎ বেদনা না থাকলে মহৎ কাব্য কোনােদিন সৃষ্টি হতে পারত না। এটিই সবচেয়ে বড় সত্য । সুতরাং অন্ধকার
থেকে মুক্তির আশায় আলাের সন্ধান করতে হবে; আনন্দকে সঠিক উপলব্ধির জন্য বেদনাকে জয় করতে হবে। কারণ আলাে-আঁধারের, সুখ-দুঃখের অবস্থান পাশাপাশি । এসবের মােকাবেলার মাধ্যমেই জীবন হৰে সুখী, ও সার্থক।

মন্তব্য : জগতে যদি বৈচিত্র্য না থাকত তাহলে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ইত্যাদি অনুভূতির কোনাে অস্তিত্বই থাকত না। তাই এ জগতে কোনােকিছুই তুচ্ছ ও মূল্যহীন নয়।

 

বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি
 চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,
 অর্ধেক তার নর।
মূলভাব : নারীরা সমাজেরই অর্ধাংশ। নারীকে বাদ দিয়ে সমাজের সার্বিক কল্যাণ বা অগ্রগতি সম্ভব নয়। কেননা আদর্শ সমাজ রচনায় নারী ও পুরুষ একে অপরের সহকর্মী।

ভাব-সম্প্রসারণ : পৃথিবী নামক যানের দুটি চাকা। তা হলাে- নর ও নারী। এর একটিকে বাদ দিলে যানটি চলার অযােগ্য হয়ে পড়বে-এটাই সত্য। আর এ দুই চাকা বিশিষ্ট যান সুদীর্ঘকাল ধরে সভ্যতার পথে এগিয়ে চলছে। মূলত পৃথিবীর এ রূপ-সৌন্দর্য, নানা রকম ঐশ্বর্য ও সম্পদের পূর্ণতার পেছনে মানবজাতির দুই শ্রেণিরই অবদান রয়েছে। অথচ এ পৃথিবীর পুরুষেরা তা মানতে নারাজ। ফলে পুরুষশাসিত এ সমাজে সর্বক্ষেত্রে নারীরা হচ্ছে অবহেলিত।

কোনাে কোনাে সমাজে নারীরা ঘরের বাইরেও বের হতে পারে না। স্বাভাবিক
জীবন যাপন তাদের জন্য নিষিদ্ধ। এ সামাজিক বৈষম্যের অবসান হওয়া দরকার । পুরুষ তার পেশিশক্তি, আকার-আকৃতি আর সমাজশক্তির জোরে পৃথিবী শাসন করবে তা হতে পারে না। তাই আজ নারীর যথার্থ মূল্যায়ন করতে হবে। বর্তমানে সমাজের প্রতিক্ষেত্রে নারীদের অবাধ বিচরণ। নারী ছাড়া পুরুষ বিকলাঙ্গও বটে। তাই নারীকে তার মর্যাদার স্বীকৃতি দিতে হবে। শুধু কথায় নয়, আইন করে তাদের দিতে হবে। সম-অধিকারের মর্যাদা। তাহলেই পৃথিবী এতদিনের অভিশাপমুক্ত হবে।

পৃথিবী অলস ভীরু কাপুরুষদের জন্য নয়

মন্তব্য: পৃথিবীর যাবতীয় মহান সৃষ্টির পেছনে নারীর সেবা, যত্ন ও সাধনা বিদ্যমান। তাই নারীকে সম্মান করা আমাদের সবার কর্তব্য।
 
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যে বা আমি বাঁধি তার ঘর, আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মােরে করেছে পর।
 
মূলভাব: অসাধারণ প্রীতি ও অকুণ্ঠ ভালােবাসা দিয়ে সব মানুষের হৃদয় জয় করতে পারাই সত্যিকার মনুষ্যত্ব।

সম্প্রসারিত ভাব: সহনশীলতা, মমতা ও ভালােবাসা মানুষকে মহৎ করে। মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ববােধ জাগ্রত করে। সহা
 
 
নুভূতিশীল হয়ে মানুষের উপকার করার মধ্যেই সত্যিকারের মনুষ্যত্ব প্রকাশিত। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিহিংসা পরিহার করে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। কবির দুর্বলতার সুযােগে অনেকেই তাকে ব্যথা দিয়েছে। সে কবির প্রিয়জনকে কেড়ে নিয়ে কবির হৃদয়ে শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু কবি কোনাে বিরূপ প্রতিক্রিয়া না করে তাকে আপন করে পাওয়ার জন্য ব্রতী হয়েছেন। যে যেভাবেই তার প্রতি শত্রুতা করতে প্রয়াসী হােক না কেন, প্রতিদানে তিনি দেবেন মমতা ও ভালােবাসা, ধারণ করবেন অসীম সহনশীলতা। কেউ যদি কবির ঘর ভেঙে দেয়, তাকে ঘর ছাড়া করে, প্রতিদানে তিনি তার ঘর বাঁধার কাজে ব্রতী হবেন। তাকে আপন করে পাওয়ার জন্য পথে পথে ঘুরবেন। কেউ যদি তার ক্ষতি করে, তার প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে কিংবা কঠিন আঘাতে অন্তর জর্জরিত করে, কবি তাতে একটুও রাগ করবেন না। প্রতিদানে তিনি কাটার বদলে দেবেন ফুলের মালা। সকল শত্রুতা, হিংসা-দ্বেষ ও নিষ্ঠুরতাকে তিনি জয় করবেন মমতা, ভালােবাসা দিয়ে। যে যতই বিমুখ হােক, তার প্রাণে যতই আঘাত দিক না কেন, তিনি নির্দ্বিধায় তা সহ্য করবেন। যে ব্যক্তি আঘাতের প্রতিঘাত হানে না, তার মধ্যে রয়েছে অসীম ধৈর্য। যে শত্রুকে বুকে টেনে নেয়, সেই প্রকৃত মানুষ, মানবতার মুকুট।

মন্তব্য: সহনশীলতা, মমতা, ভালােবাসার মাধ্যমেই সমাজের প্রকৃত উন্নতি সম্ব। এটিই হওয়া উচিত আমাদের মূলমন্ত্র।
 
 
                                                             নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে
অথবা, নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস ভাবসম্প্রসারণ

 মূলভাব ; পার্থিব জীবনে কোনাে মানুষই নিজের বর্তমান অবস্থায় সুখী নয়। প্রত্যেকেই অপরকে সুখী ভেবে নিজের কষ্ট বাড়ায়।


ভাব-সম্প্রসারণ : দৃশ্যমান জগৎ সংসারে প্রতিটি মানুষ নিরত্র সুখের সন্ধানে ব্যস্ত। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা তাই অহীন। প্রকৃত সুখের সন্ধান কেউ পায় না। নদীর এপার ভাবে-ওপারই সর্বাধিক সুখী। আবার নদীর ওপার ভাবে-এপারেই রয়েছে সুখের সমুদয় উপাদান। সংসারে একজন ভাবে তার মতাে দুঃখী আর কেউ নেই। অথচ প্রকৃত বিচারে তার গ্রহণযােগ্যতা খুবই অল্প। কেননা মানুষের অফুরন্ত চাহিদাই তাকে দুঃখী করে। আর মানুষের আকাঙক্ষা করার ক্ষমতা অসীম, কিন্ত তাকে রূপদানের ক্ষমতা তার সীমিত। তাই সে
আকাক্ষা করে প্রচুর, কিন্ত পায় তার সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র। এটাই তার চিরন্তন অতৃপ্তির কারণ। বাস্তবিক, আমরা যা কিছু চাই তা পাই  আর যা কিছু পাই তা চাই না। সােনার হরিণের সন্ধানে অন্ধ আবেগে আমরা তার পশ্চাৎ ধাবন করতে পারি মাত্র, কিন্ত তার নাগাল কোনােদিনই পাই না। এভাবে পার্থিব সুখ অন্বেষণে ক্লান্ত হয়ে মানুষ চিরকাল শুধু অসম্ভবের পদতলে মাথা কুটে মরে।

মন্তব্য : মানবজীবন চিরকাল সুখ-শান্তিতে কাটে না। আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। চাওয়া- পাওয়ার গডি তাই মাটির কাছাকাছি হওয়াই ভালাে।

রাত যত গভীর হয় প্রভাত তত নিকটে আসে 

মূলভাব : দুঃখের পর সুখ আসে, এটিই জগতের নিয়ম। বরং দুঃখ যত বেশি হবে তত দ্রুত সুখের আগমন ঘটবে। কেননা একের শেষেই অন্যের আবির্ভাব।

ভাব-সম্প্রসারণ : সৃষ্টিকর্তার এ পৃথিবীতে সবকিছুই চলছে নিয়মের মাধ্যমে। এখানে সবকিছুই পর্যায়ক্রমে আসে। মানবজীবনে সুখ-দুঃখও তেমনি একটি বিষয়। জীবনে সুখ-দুঃখ কারাে চিরস্থায়ী নয়। সুখের দিন যত ফুরিয়ে আসে দুঃখের রাত ততই নিকটবর্তী হয়। আবার
রাত যত গভীর হয় সুখের প্রভাত তত কাছে আসে। এটিই জীবনের ধর্ম। ইংরেজিতে একটি কথা আছে-Adversity often leads to prosperity. অর্থাৎ দুঃখের পরিণতি সুখ। এ জীবনে দুঃখ-কষ্টকে দেখে হতাশ হবার কিছু নেই। মনে রাখতে হবে আজ যারা সুখের স্বর্গে বাস করছে, তাদের সুখ একদিনে আসে নি। হাজারাে উত্থান-পতনের মাধ্যমে এর আগমন। তাই আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, দুঃখ-কষ্টের প্রবহমান স্রোতই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায় সুখ-সমৃদ্ধির পথে ।

মন্তব্য : রাত যত গভীর হয় ততই তা দিনের সান্নিধ্যে আসে-এটিই প্রকৃতির নিয়ম। সুতরাং হতাশার চাদর ফেলে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলাতেই জীবনের সার্থকতা।
 
 

পাপকে ঘৃণা কর পাপীকে নয়

 মূলভাব; মানুষ জন্মের সময় নিস্পাপ হয়েই জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তীতে চলমান সমাজজীবনের পাল্লায় পড়ে নিজের অজ্ঞাতেই একদিন সে পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে। তাই পাপীকে ঘৃণা না করে সবারই পাপকে ঘৃণা করা উচিত।

ভাব-সম্প্রসারণ ; মানুষ সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষ যখন পৃথিবীতে আসে তখন সে থাকে নিস্পাপ। ক্রমশ সে বড় হতে থাকে। একসময় সে জিবনের তাগিদে অর্থের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে এবং বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। কিন্ত তার এ চলার পথে নিজের অজান্তেই কিংবা সার্বিক পরিস্থিতি অনেক ক্ষেত্রেই তাকে ধাবিত করে অন্যায় পথে। ফলে সে হয় পাপী। অথচ সে 'পাপী' হয়ে জন্মায় নি। আমাদের সমাজে এরূপ অসংখ্য পাপীর সন্ধান পাওয়া যায়। তাদের জীবন ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, তাদের 'পাপী' হওয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। আমরাই তাদেরকে পাপী হতে বাধ্য করছি। অথচ আমরা তাদের সঠিক পথে আনার চেষ্টা না করে আরাে অবহেলা করি। এটি মােটেও ঠিক নয়। অনুকূল পরিবেশ আর মায়া-মমতায় পাপীরাও চায় সুন্দরভাবে বাঁচতে । আর আমরা সে সুযােগ না দিয়ে উল্টো পাপীদের এড়িয়ে চলি। আমাদের এ ধরনের মানসিকতা একজন পাপীর সংশােধনের অন্তরায়। এর ফলে পাপের মাত্রা আরাে বেড়ে যায়। পাপী অবহেলিত হলে সাধারণের প্রতি তার মনের ক্ষোভ আরাে বেড়ে যায়। কাজেই পাপীকে ঘৃণা করা উচিত নয়।

মন্তব্য ; আমাদের সবাইকে এ সমাজ গঠনে এগিয়ে আসতে হবে। সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য পাপীকে বুকে টানতে হবে। আর পাপকে ঘৃনা করতে হবে।

প্রাণ থাকলেই প্রাণী হয় কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না

 ভাব সম্প্রসারণ: প্রাণ থাকলে প্রাণী হয়, কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না।
অথবা, তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপাখি সহজেই পশুপাখি কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ।
 
 মূলভাব : প্রাণ থাকলেই মানুষকে প্রকৃত মানুষ বলা যায় না। মানুষ নামের যােগ্য হতে হলে তাকে হতে হবে বড় মনের অধিকারী।
ভাব-সম্প্রসারণ : যাদের প্রাণ আছে তাদের প্রাণী বলা হয়। পৃথিবীতে অসংখ্য প্রাণীর মধ্যে মানুষও এক শ্রেণির প্রাণী। প্রাণের দিক দিয়ে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে কোনাে তফাৎ নেই। মানুষের এমন কতকগুলাে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে যা মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে পৃথক করেছে। আর এজন্যই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত' অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের এ শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হচ্ছে তার বিবেক। মনের বিকাশের মাধ্যমেই মানুষ মহৎ গুণাবলি অর্জন করতে পারে এবং ভালাে-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করতে পারে। আর এ জন্যই সেবা,
সত্যনিষ্ঠা, ধৈর্য, তিতিক্ষা ইত্যাদি গুণাবলির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে মানুষের জীবন। সুন্দর মন এসব গুণাবলির ধারক ও বাহক। মানুষের মধ্যে এ সুন্দর মন নিহিত থাকার জন্যই মানুষ নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করে। শুধু তাই নয়, শান্তি ও মৈত্রীর কথা ভেবে মানুষ বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। অপর দিকে মনহীন প্রাণী, তারা প্রাকৃতিক নিয়মে জন্মগ্রহণ করে ও পূর্ণতা পায়। বলাবাহুল্য তারা এ পূর্ণতার জন্যে যত্ন বা সাধনায় ত্যাগ স্বীকার করে না। তাই তারা প্রাণী, অথচ মানুষের ক্ষেত্রে ঠিক এর বিপরীত। কেবল আকৃতিতে মানুষ হলেই তাকে মানুষ বলা যায় না। তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকতে হয়। তাই সব মানুষ প্রাণী কিন্তু সব প্রাণী মানুষ নয়। কারণ সব প্রাণীর প্রাণ আছে বটে কিন্তু মন নেই। কাজেই বলা যায়, কেবল প্রাণ নয়, মনই মানুষকে মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী করে তােলে।
মন্তব্য: মন মানুষকে পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে উন্নীত করে। মানুষ হতে হলে সুন্দর মনের অধিকারী হতে হবে।

মঙ্গল করিবার শক্তিই ধন, বিলাস ধন নহে

 

মূলভাব : মানব কল্যাণে ব্যয়িত ধনই প্রকৃত ধন, বিলাসিতা বা অপ্রয়ােজনে ব্যয়িত ধন প্রকৃত ধন নয়।

 ভাব-সম্প্রসারণ: ধন-সম্পদ মহান আল্লাহ্ তা'আলার দান। আল্লাহ্ তা'আলা এ পৃথিবীতে মানবজাতি প্রেরণ করেছেন এবং তাদের জীবনকে আরামপ্রদ করে তােলার নিমিত্তে ধন-সম্পদ দান করেছেন। মানুষ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করে। কিন্তু এর সার্বিক ব্যবহার না জানলে তা ধনী-গরিব সব ব্যক্তির জন্য এক মহা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ ধনবান ব্যক্তিই বিলাসিতায় অর্থ ব্যয় করে থাকে। কিন্তু এ বৃহৎ সমাজ ও রাষ্ট্রের অগণিত আর্ত পীড়িত মানুষের মুখগুলাে তাদের দিকে চেয়ে থাকে একমুঠো অন্নের আশায়। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয় যে, ধনীরা গরিবদেরকে সাহায্য করা তাে দূরের কথা অপমানিত করতেও দ্বিধাবােধ করে না। কিন্তু তারা জানে না, নিজ জীবনের কামনা-বাসনাকে বড় করে দেখে, আরাম আয়েশের দিকে লক্ষ্য রেখে যারা সম্পদের পাহাড় গড়ে, তারা প্রকৃত ধনে ধনী নয়। মূলত দরিদ্রের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া তথা আর্তের মঙ্গল করার মাঝেই ধনের প্রকৃত ব্যবহার নিহিত। মানুষ ধনার্জন করে, ধনের পাহাড় গড়ে তােলে, কিন্তু ধনের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে না।
আল্লাহ পৃথিবীর সবাইকে ধনী বানান নি। এটি তার পরীক্ষা। ধনীদের যে অর্থ সম্পদ রয়েছে তাতে গরিবদেরও অধিকার রয়েছে। সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে “তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিত লােকদের হক বা অধিকার রয়েছে। সমাজের এতিম, অসহায়, পঙ্গ, সর্বহারাদের জন্য যে ধন ব্যয় হয় না, সে ধনের কোনাে মূল্য নেই। মঙ্গল সাধনে অর্থ ব্যয় করার মধ্যেই প্রকৃত গৌরব নিহিত। দুস্থ মানবতার সেবায় ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারতা সাধনে, ত্যাগের মঙ্গল সাধনে ধন-সম্পদ ব্যয় করা সবার একান্ত কর্তব্য। “যে ধন অন্যের মঙ্গলে ব্যয়িত না হয়ে কেবল বিলাসিতায় ব্যয়িত হয় সে ধনের কোনাে সার্থকতা নেই। নবী করীম (স) বলেছেন, যে নিজে তার পরিবারের সাথে আহার করে অথচ তার প্রতিবেশী পরিবার অভুক্ত থাকে, সে আমার উম্মত নয়।” বিচিত্র পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় ভুবনে যারা ফুর্তিতে অর্থ ব্যয় করে, তাদের বিষাক্ত ছােবলে কলুষিত হয় সমাজ আর রাষ্ট্র। যদি অর্থ মানব কল্যাণে ব্যয়িত হয় তবেই তা হয় ধনের সঠিক মূল্যায়ন। তাই আল্লাহ প্রদত্ত ধনকে ব্যক্তিস্বার্থে নয়; বরং সমাজ আর রাষ্ট্রের স্বার্থে ব্যয় করাই একজন প্রকৃত ধনবান ব্যক্তির কর্তব্য।

মন্তব্য: ধন-সম্পদ বিলাসিতায় ব্যবহার না করে তা জনকল্যাণে ব্যবহার করা উচিত।

 

সুজনে সুযশ গায় কুযশ ঢাকিয়া, কুজনে কুরব করে সুরব নাশিয়া

 মূলভাব : 'সু' এবং 'কু' একে অপরের বিপরীত। সাধারণ ভাবে সকল ভাললাকে ‘সু' বলা যায় এবং সকল খারাপকে ‘কু বলা যায়। অনুরূপ ভাবে সুজন ও কুজনের সম্পর্কও বিপরীত। আমাদের সমাজে এই দু’প্রকার লােকেরই অস্তিত্ব রয়েছে। সুজন লােক তারাই যারা অপরের দোষ-ত্রুটি গােপণ করে ভাললাদিক প্রচার করেন। অন্যদিকে, কুজন লােক অপরের ভালাে কাজ গােপন রেখে খারাপ কাজগুলাে প্রচার করে।

ভাব-সম্প্রসারণ : আমাদের সমাজে বিচিত্র রকমের লােকের বসবাস। কোনাে ব্যক্তিকে চেনা যায় তার আচার-আচরণ, ব্যবহার, কথাবার্তা এবং কাজ-কর্মে। সমাজে সুজন লােকের সংখ্যা প্রকৃত ভাবে কম। সুজন ব্যক্তি সবসময় সমাজের ভালাের জন্য কাজ করে যান। অপরের কীভাবে কল্যাণ করা যায় সেই চিন্তায় তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। সুজন ব্যাক্তি অপরের দোষ-ত্রুটি গােপন রাখেন, প্রচার করেন না। বরং খারাপ ব্যক্তির ভালাে কাজ গুলাে প্রচার ও প্রশংসা করে তাকে ভালাে কাজ করতে উৎসাহিত করেন। একে বলা যায় খারাপ ব্যক্তিকে সংশােধন করার একটি প্রয়াস। প্রকৃত পক্ষে সুজন ব্যক্তি নিজে ভালাে বলেই অপরের ভালাে কাজ দেখতে পারেন এবং অপরের সুন্দর মনের সন্ধান পান। অপর দিকে কুজন বা খারাপ চরিত্রের লােক অপরের ভালাে দেখতে পারে না। তারা নিজেরা শুধু খারাপ কাজ করেই ক্ষান্ত হয় বরং কীভাবে অন্যের ক্ষতি করা যায় সেই চিন্তায় মশগুল থাকে। সে অপরের ভালাে কাজের কথা গােপন রেখে ভালাে কাজকেও খারাপ বলে প্রচার করে। অন্যের চরিত্রের দুর্বল বা নেতিবাচক দিকটি খুঁজে বের করে তা প্রচার করে বেড়ানােই কুজনের কাজ। সে যেহেতু নিজে খারাপ প্রকৃতির তাই অপরের গুণ প্রত্যক্ষ করার তার কাজ নয়। অপরের দোষ ধরা বা ক্ষতি করাই তার ধর্ম। বর্তমান সমাজে কুজনের সংখ্যাগরিষ্ঠতাই বেশি।

ফলে বর্তমান সমাজে এত বিশৃঙ্খলা চোখে পড়ে। সমাজকে তারা অনিবার্য বিপদের দিকে প্রত্যহ ঠেলে দিচ্ছে। সুজন বা মহৎ ব্যক্তিগণ যেখানে সমাজের উন্নয়নকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে কুজন বা খারাপ চরিত্রের লােকেরা উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে পেছন থেকে টেনে ধরছেন।

মন্তব্য: সমাজে ভালাে ও মন্দ উভয় শ্রেণির লোকই বাস করে। দুর্জন বিদ্বানকে চিহ্নিত করে আমরা যেমন তাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকি তেমনি সুজন ও কুজনকে আমাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং কুজনকে পরিত্যাগ করতে হবে।

পথ পথিকের সৃষ্টি করে না, পথিকই পথের সৃষ্টি করে

 মূলভাব: উক্তিটি রূপক তাৎপর্যে অনুপম। এর আক্ষরিক অর্থ এই যে, আসলে পথ পথিকের সৃষ্টি করতে পারে না, পথিকই পথের সৃষ্টি করে।

ভাব-সম্প্রসারণ: জীবনচক্রে আবর্তনকারী পথিক মহাজীবনের রথ, সে গতির প্রতীক। পথিকের পদচিহ্নে অঙ্কিত হয় পদরেখা। এ ক্ষেত্রে উক্তিটি অত্যন্ত তাৎপর্য পূর্ণ ও অর্থবহ। এ পৃথিবীতে মানুষের পদচিহ্নকে বুকে ধারণ করেই পথের উৎপত্তি হয়েছে। পথিক পথের সৃষ্ট বস্তু নয়। ঠিক একইভাবে মানুষ কখনাে অদৃষ্টের তৈরি বস্তু হতে পারে না। প্রবাদ আছে—Man is the architect of his own fortune. সে নিজের সাধনা ও ঐকান্তিক কর্ম প্রচেষ্টার দ্বারা নিজের ভাগ্য গড়ে তােলে। কপাল গুণে মানুষ বড় হয় না, বড় হয় কর্মের মাধ্যমে। অর্থাৎ, মানুষ নিজেই তার সৌভাগ্যের ধারক ও বাহক। এটি কেউ কাউকে দান করতে পারে না।

অতএব মানুষের মুক্তির জন্য যেসব মহাপুরুষ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন, তাঁরাই সঠিক পথের পথিক। তাঁদের পথ নির্দেশনা প্রতিটি মানুষের আত্মমুক্তির ক্রমিক পরিণাম। তাদের প্রদর্শিত পথে চলে প্রত্যেক মানুষ স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠতে পারে। তাই মহাজ্ঞানী, মহাজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা যদি তাদের প্রদর্শিত পথে চলতে পারি তাহলে আমরাও স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকতে পারব।

মন্তব্য: মহৎপ্রাণ মানুষেরা আমাদের অগ্রপথিক। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণে আমাদের জীবন কল্যাণমুখী হয়।

 

দুর্নীতি জাতির সকল উন্নতির অন্তরায়

 মূলভাব : জাতীয় উন্নতির জন্য প্রয়ােজন স্বচ্ছতা, সততা, ন্যায়নীতি ও আইন-শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু নীতির পরিবর্তে জাতি যদি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়, তবে কোনাে কাজেই সফলতা আসবে না। জাতীয় জীবনে নেমে আসবে বিপর্যয়। কারণ দুর্নীতি জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। 
ভাব-সম্প্রসারণ: দুর্নীতি শব্দের অর্থ নীতিহীনতা, অনৈতিকতা, অন্যায় ও বেআইনি কাজকর্ম।জাতীয় জীবনের উন্নতির জন্য যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে দুর্নীতি তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। দুর্নীতি জাতীয় জীবনের অভিশাপ, সব উন্নতির অন্তরায়। জাতীয় জীবনে যখন দুর্নীতি বা নীতিহীনতা বিরাজ করে জাতি তখন সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে। দুর্নীতি জাতীয় জীবনে চরম সর্বনাশ ডেকে আনে। সত্য ও ন্যায়নীতির পথে চললে জাতীয় উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। সেজন্য জাতীয় উন্নয়নের জন্য প্রয়ােজন সত্য ও ন্যায়নীতির সাধনা করা। সুশিক্ষা অর্জন করতে পারলে তা সহজ হয়। কিন্তু অশিক্ষা-কুশিক্ষা জাতীয় জীবনে ডেকে আনে দুর্নীতি ও মহা বিপর্যয়। আমাদের বাংলাদেশ এক্ষেত্রে প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এদেশের শিক্ষাঙ্গনসহ শিক্ষার সাথে জড়িত সব প্রতিষ্ঠান চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। ঘুষ বা উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ফোন ছাড়া সেখানে কোনাে কাজই উদ্ধার করা যায় না। তাছাড়া দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাদের হাতে, তারাই হচ্ছে বেআইনি কাজ কর্মের আসল হােতা। আর যারা দেশের চালিকা শক্তি, রাজনীতিবিদ তাদের কথা তাে বলাই বাহুল্য।
তারা নানা রকমের বেআইনি ব্যবসায় আর ঘুষ খেয়ে টাকার পাহাড় বানায়। নির্বাচন করে ক্ষমতার বলে এমন কোনাে অনৈতিক কাজ নেই যা তারা করে না। তাদের সাথে যােগ দেয় দেশের সচিব থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত যত আমলা কর্মচারী। যে যেভাবে পারে লুটে-পুটে খায়। মাঝখান থেকে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনাে পরিবর্তন ঘটে না। পরপর পাঁচ বার দুর্নীতিতে বিশ্বে সেরা হলাে বাংলাদেশ। যার জন্য স্বাধীনতার ৩৬ বছর পরও দেশের তেমন কোনাে উন্নতি হয় নি বা হচ্ছে না। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলাে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে ন্যায়নীতি ঠিক থাকার কারণে। তাই নিজ দেশের প্রতি তাকিয়েই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, নিশ্চয়ই দুর্নীতি জাতির উন্নতির অন্তরায় বা দুর্নীতি জাতীয় জীবনের অভিশাপ স্বরুপ ।

মন্তব্য: দুর্নীতি এক মারাত্মক ব্যাধি । এ ব্যাধিতে পচন অনিবার্য। উন্নয়নের জন্য ন্যায়নীতির প্রতিষ্ঠার কোনাে বিকল্প নেই।
 
 

লােভে পাপ, পাপে মৃত্যু

 ভাবসম্প্রসারন: লােভে পাপ, পাপে মৃত্যু।

মূলভাব: লােভ মানুষকে পাপ পথে পরিচালিত করে আর পাপ মানুষকে ধবংস বা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।

 

ভাব-সম্প্রসারণ : মানুষের ছয়টি রিপুর মধ্যে ভয়ানক রিপু হচ্ছে লােভ। লােভ চরিত্রের এক দুর্দমনীয় কু-প্রবৃত্তি। লােভী মানুষ পশুর সমান । পশুরা যেমন যে কোনাে কাজ করতে পারে তেমনি লােভী মানুষ স্বীয় স্বার্থের জন্য হেন কাজ নেই যা করতে পারে না। মানুষ যখন লােভের পথে পা বাড়ায় তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কম-বেশি লােভ আছে। কিন্তু সবারই উচিত লােভকে সম্বরণ করা। কারণ লােভ মানুষকে পাপ পথে টেনে নেয়; অন্যায় কাজে লিপ্ত করায় । জীবনে তখন নেমে আসে চরম দুঃখ-দুর্দশা । আমাদের জগৎ-জীবনের সর্বত্রই রয়েছে লােভের হাতছানি। অর্থ-বিত্ত, খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতা প্রভৃতির প্রতি মানুষের রয়েছে অদম্য লােভ। লােভী মানুষ কখনাে পরিণতি ভেবে দেখে না। অন্ধের মতাে অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়। নিজের সামান্য স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে তারা অন্যের জীবন পর্যন্ত কেড়ে নিতে পারে।

লােভের মায়া জালে আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ ভাইবােন, মা বাবা, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ভুলে অন্ধকার জগতের দিকে চলে যায়- যে জগৎ তাকে ধ্বংস করে দেয়। এজন্য বিভিন্ন ধর্মে লােভকে পাপ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আর পাপ হচ্ছে আগুনের মতাে। পাপ যাকে স্পর্শ করে, তাকে দগ্ধ করেই ছাড়ে। আগুনের হাত থেকে যেমন কোনাে কিছু রক্ষা পায় না, পাপের হাত থেকেও তেমনি কেউ নিস্তার পায় না। পাপ হচ্ছে আত্মঘাতী অস্ত্র । আর সে অস্ত্রের স্রষ্টা হচ্ছে লােভ। যার যত লােভ আছে, তার তত দুর্ভোগ আছে। প্রবাদ আছে- “অতি লােভে তাঁতী নষ্ট।” লােভের বশীভূত হয়ে মানুষ এমন পাশবিকতা-বর্বরতার কাজ করে, যা সুস্থ মস্তিষ্কে ভাবাও যায় না। যার ফলে পরবর্তীতে যেমন সে অন্তরে অন্তরে দগ্ধ হয়, অন্যদিক থেকে পরিণামে ধবংসপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ লােভ আর পাপ পরস্পর মিলে মানুষকে ধ্বংস করে দেয়, দেয় মৃত্যুর দিকে ঠেলে।

মন্তব্য : জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করতে চাইলে লােভ বর্জন করতে হবে। লােভ না করলে পাপের ভয় থাকবে না। পাপ না থাকলে পতনের বা ধ্বংসেরও ভয় থাকবে না। তখনই মিলবে প্রকৃত সুখের সন্ধান।

 

বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে 

মূলভাব : বিনয় এবং নম্রতা দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা যায়। যারা অহঙ্কারকে বর্জন করতে পারে এবং বিনয়ী হতে পারে তারাই অপরের নিকট থেকে যথার্থ মর্যাদা লাভ করে এবং সুনাম সুযশ অর্জন করে। 

সম্প্রসারিত ভাব : মানব চরিত্রের বিভিন্ন গুণাবরীর মধ্যে বিনয় একটি বিশেষ গুণ। বিনয় দ্বারাই মানুষ মানুষের মন জয় করে থাকে। বিনয় স্বর্গীয় সুষমা ছড়ায়। আর এর সাহায্যেই মানুষ সম্মানের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। অহঙ্কার মানুষের চরিত্রকে ধ্বংস করে। অহঙ্কারী মানুষ করো কাছে সমাদৃত হয় না। সমাজে অনেক ব্যক্তিকেই ধন, মান কিংবা বংশ গৌরব জাহির করতে দেখা যায়। এটা উচিত না। কারণ ধরনের ব্যক্তিরা কারো নিকট হতে সম্মান পায় না, বরং ঘৃণার পাত্র হয়। চরিত্রগুণে যেসব মহান ব্যক্তি পৃথিবীতে অমরতা লাভ করেছেন, তাঁদের জীবনী পর্যালোচনা করলে জানা যায়, তাঁরা সকলেই বিনয়ী ছিলেন। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (.) বিনয় দ্বারাই মানুষের মন জয় করেছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হাজী মহম্মদ মুহসীন প্রমুখ মনীষী বিনয়ের এক একটি শ্রেষ্ঠ মূর্ত প্রতীক। বিনয় দ্বারাই তাঁরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অকৃত্রিম ভালোবাসা লাভ করেছিলেন। জগতের মানুষ তাইতো এখনো তাঁদেরকে পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকে। একথা সত্য যে সাধারণ মানুষের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে কেউ বড় হতে পারেনি। পরম প্রতাপশালী অহঙ্কারী রাজা-বাদশারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। পৃথিবীর মানুষ ঘৃণাভরে তাঁদের নাম উচ্চারণ করে থাকে। 

সম্মান পেতে হলে অপরকে সম্মান করতে হবে। অপরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সাথে বিবেচনা করা অর্থ নিজের বড় হওয়ার পথকে রুদ্ধ করা

যত মত, তত পথ     

মূলভাব : পৃথিবীতে বিভিন্ন মত দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে এটা স্বাভাবিক। মত আর দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতাহেতু মানুষের জীবন এবং কর্মের ভিন্নতাও খুবই স্বাভাবিক বিষয়।          

সম্প্রসারিত ভাব : সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষের মধ্যে ভিন্নতার বিষয়টি বিদ্যমান। মানুষ চিন্তা চেতনা আর দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাসের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই পরস্পর থেকে ভিন্ন হতে পারে। ভিন্নতা তাদের জীবনাচার, ধর্মকর্ম লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয়। এক ধর্মে বিশ্বাসী বা অনুসারীদের জীবনাচার, চালচলন, রীতি নীতি অন্যদের চেয়ে ভিন্ন হবে। কেননা, মত বিশ্বাসের ভিন্নতার সাথে জীবনের বাহ্যিক আত্মিক অনেক বিষয়ই জড়িত। ব্যক্তির জীবনাচার কর্মের মাঝে তার মতের প্রতিফলন ঘটতে পারে। মতের ভিন্নতার কারণে যে পথেরও ভিন্নতা হতে পারে সত্যটাকে যখন মানুষ উপলব্ধি করতে পারে তখন ভিন্নতার মাঝেও ঐক্যের সুর শোনা যায়; পারস্পরিক সহনশীলতার মাধ্যমে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যায়। কেননা মানুষ যখন বুঝতে পারে, তার নিজের যেমন একটা মত বা একটা বিশ্বাস আছে এবং সে মত বিশ্বাস তাকে একটা নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করে, তেমনি অন্যের ক্ষেত্রেও তা স্বাভাবিক। এবং তখন তার মাঝে এসব কিছু মেনে নেওয়ার মনোবৃত্তি জন্ম নেয়। এমনিভাবে সকল মানুষের মাঝে এরূপ মনোবৃত্তির বিকাশ হলে অনেক ভিন্নতার মাঝেও মানব সমাজে শান্তির ধারা প্রবাহিত হতে পারে। কিন্তু যখনই এর ব্যতিক্রম ঘটে তখনই দেখা যায় এক ধর্ম আর বর্ণের মানুষ অন্যদের সহ্য করতে চায় না। শুরু হয় সাম্প্রদায়িক রেষারেষি, বিনষ্ট হয় মানব সমাজের শান্তি আর সমৃদ্ধি। মানুষের নিজের মতকে অপরের উপর চাপিয়ে দেওয়ার নীচু মনোবৃত্তি তাকে যেমন করে তোলে উগ্র, তেমনি সেও অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের মুখোমুখী হয়। যুগে যুগে মানব জাতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে এবং বর্তমানেও বিশ্বের আনাচে-কানাচে মানুষকে তার মাশুল গুণতে হচ্ছে। শক্তিশালী জাতি, ধর্ম আর বর্ণের মানুষ নিজের মতকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য তৎপরতা আজো থামায়নি, বরং প্রতিনিয়ত এর জন্য নানা ফন্দিফিকির আবিষ্কার করছে।    

মানব সমাজ থেকে ঘৃণ্য প্রবৃত্তির উচ্ছেদ যতদিন সম্ভব না হবে ততদিন মানবজাতিকে এর মূল্য দিতেই হবে। মনে রাখতে হবে দিন শেষে আমরা সকলেই একই গ্রহের মানুষ  

যে সহে সে রহে

মূলভাব : যারা সহিষ্ণু ধৈর্যশীল তারাই কেবল জগৎ সংসারে সফলকামী হতে পারে। 

সম্প্রসারিত ভাব : দুঃখ-বিপদাপদের মধ্য দিয়ে মানুষের যাত্রা শুরু হয়। তাকে সংগ্রাম করতে হয় নানা প্রতিকূল অবস্থার সংগে। শীত-তাপ, রোগ-শোক, দুঃখ-দারিদ্র্য সবের চাপে মানব পর্যুদস্ত হয়, চোখে বিভীষিকা দেখে। কিন্তু সবের জন্য চাই শক্তি, অধ্যবসায় সহিষ্ণুতা। দুঃখ-বিপদ জয় করতে পারাটাই মনুষ্যত্ব। যুদ্ধে জয়-পরাজয় আছেই। কিন্তু যে মানুষ পরাজয়কে অম্লানবদনে মাথা পেতে নিয়ে পরবর্তী বিজয়ের জন্য ব্রতী হয় এবং বিজয় অর্জন করতে পারে সে- যথার্থ বীর। আসলে সহিষ্ণুতা সকল শক্তির উৎস। আমরা স্কটল্যান্ডের বীর সেনাপতি রবার্ট ব্রুসের কথা জানি। বার বার পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও ব্রুস ধৈর্য ধারণ করেছিলেন এবং সহিষ্ণুতা গুণে তিনি স্কটল্যান্ড জয় করেছিলেন। জীবনে যে যত উন্নতি করতে চায় তাকে তত সহিষ্ণু হতে হবে। সহিষ্ণুতা যার নেই সে বড় হতে পারে না। তার দ্বারা বড় কাজ সম্ভবপর নয়। যাঁর চরিত্রে হিমাচলের মত ধৈর্য তিতিক্ষা আছে তিনিই অক্ষম কীর্তি স্থাপন করতে পারেন। ত্যাগ আর ধৈর্যই মানব জীবনে সুখ-শান্তি লাভের পূর্বশর্ত। 

আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে 

আসে নাই কেহ অবণী পরে,

সকলের তরে সকলে আমরা 

প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। 

উপলব্ধিকে জগতে ধারণ করেছেন বিভিন্ন ধর্মের মহান পুরুষরা। হযরত মহাম্মদ (.), যীশু খ্রিস্ট, বুদ্ধদেব প্রমুখ ধর্ম প্রবক্তারা উপলব্ধিকেই লালন করেছেন এবং লালন করতে বলেছেন তাঁদের অনুসারীদের। মানুষের সব সৃষ্টিকর্ম সম্পদ বৃহৎ জগতের কাছে নিয়োজিত করতে পারলেই সেগুলো স্বার্থক হয়। মানুষের জীবনও সফলতায় ভরে উঠে

বুদ্ধি যার বল তার : ভাবসম্প্রসারণ


মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কেবলমাত্র প্রাণেরই অধিকারী নয়, একই সঙ্গে মেধা, মনন বুদ্ধিমত্তারও অধিকারী। গোটা প্রাণীকূলে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রধান কারণ তার বুদ্ধিমত্তা। সৃষ্টির সূচনা লগ্নে মানুষ প্রতিকূল প্রকৃতি বন্য জীবজন্তুর আক্রমণের কাছে অসহায় ছিল। আদিম অসহায় মানুষ জ্ঞান বুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সভ্যতার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে যাচ্ছে। কেননা সে জানে, জ্ঞান বুদ্ধির চর্চার জোরেই মানুষ আজ সভ্যতার শীর্ষে অবস্থান করছে। এটিই মানুষের সব থেকে বড় শক্তি। আপাতদৃষ্টিতে, শারীরিক শক্তির ক্ষমতা বেশী মনে হলেও বস্তুত, কৌসলি বুদ্ধিমান মানুষই অধিক শক্তিশালী। শারীরিক শক্তি দ্বারা যা অর্জন করা যায় তা অত্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, হিটলারের মতো শাসকের শারীরিক অস্ত্র শক্তির বলে ক্ষমতা লাভ করলেও পৃথিবীর ইতিহাসে তারা বরণীয় হয়ে থাকতে পারেনি বরং ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়ে তাদের নাম লেখা হয়েছে। স্বল্প সময়ের জন্য তারা গোটা পৃথিবীর শাসন ক্ষমতা নিজ হাতে নিলেও, পরবর্তীতে তারা নিন্দিত হয়েছে। তাদের অপশাসন বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। অন্যদিকে, যুগে যুগে যারা লড়াইয়ের পথ পরিহার করে, জ্ঞান বুদ্ধির চর্চা দ্বারা মানবকল্যাণে অবদান রেখেছেন, ইতিহাসে তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়েছে। শারীরিক শক্তি প্রয়োগে সমাজে, দেশে সর্বোপরি গোটা পৃথিবীতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা-অশান্তি লেগেই থাকে। কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যক্তি বিশৃঙ্খলতার পথ পরিহার করে বুদ্ধির জোরে সকল সমস্যার সহজ শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে পারে। জগতের সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানুষের সব থেকে বড় অস্ত্র জ্ঞান বুদ্ধিমত্তা

শিক্ষা: পরম স্রষ্টা একমাত্র মানুষকেই জ্ঞান বুদ্ধির সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছেন। নিজ নিজ বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পৃথিবীর কল্যাণ সাধনের জন্য স্রষ্টা মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। প্রত্যেকের উচিত নিজ বুদ্ধিমত্তাকে সৎপথে ব্যবহার করে মানবকল্যাণ সাধনে সচেষ্ট হওয়া

গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না

তিনিই গুণী, যিনি মানবীয় গুণাবলীর ধারক বাহক। তার মধ্যে মানব চরিত্রের এমন কিছু গুণ প্রতিফলিত হয়, যা দ্বারা তিনি অন্য সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা সম্মান পান। গুণী ব্যক্তি তার মেধা, প্রজ্ঞা দ্বারা মানুষের, সমাজ তথা রাষ্ট্রের বিকাশ সাধন করেন। পৃথিবীর মহান কবি, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক তারা সবাই তাদের নিজ নিজ গুণের দ্বারা মানব সম্প্রদায়ের উপকার করেছেন। তারা সবাই সম্মানের পাত্র। একটা বিষয় পরিলক্ষিত যে, এসব গুণী ব্যক্তিরা তাদের সমসাময়িক সময়ে খ্যাতি অর্জন করতে পারেননি। মানুষ গুণী ব্যক্তিদের কদর করতে শুরু করে যখন তারা জীবনের শেষ পর্যায়ে চলে আসেন, নতুবা মারা যান। মহাকবি ফেরদৌসী মহাকাব্যশাহনামারচনার প্রতিটি শ্লোকের জন্য স্বর্ণ মুদ্রা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সুলতান মাহমুদ তাকে স্বর্ণ মুদ্রার পরিবর্তে রৌপ্য মুদ্রা দেন। ফেরদৌসী রৌপ্য মুদ্রা নিতে অস্বীকার করে রাগ করে চলে যান। সুলতান যখন তাঁর ভুল বুঝতে পারেন, তখন ফেরদৌসী আর জীবিত ছিলেন না। গুণী ব্যক্তিরা যখন আমাদের সাথে সমাজে চলাফেরা করেন, তখন আমরা তাকে সমাদর করি না। তাদেরকে অবহেলা করি। তাদের গুণকে আমরা সম্মানের চোখে দেখি না। তাদের সামাজিক স্বীকৃতি সামাজিক মর্যাদা দিতে আমরা দ্বিধাবোধ করি। অথচ তারা তাদের মেধা, প্রজ্ঞা দূরদর্শীতা দ্বারা মানুষের উপকার করে থাকেন। তাই তাদের যথাযথ সম্মান করা উচিত। . মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন- “যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।তাই সমাজে তথা রাষ্ট্রে যেসব গুণী ব্যক্তি বাস করেন তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া আমাদের কর্তব্য

শিক্ষা: মানবীয় গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি শ্রদ্ধার পাত্র। তাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে সমাজে স্থান করে দিতে হবে। তার গুণের কদর করতে হবে

এক মাঘে শীত যায় না

প্রকৃতিতে মাঘ মাস আসে প্রচন্ড- শীতের তীব্রতা নিয়ে। শীতের এই তীব্রতা মানুষকে জীর্ণশীর্ণ রিক্ত করে দেয়। কিন্তু শীত গেলেই তা মানুষ ভুলে যায়। এই শীতের মতোই মানুষের জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট আসে। কিন্তু বিপদ শেষে এই দুঃখ কষ্টকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। মানুষের জীবন সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ। জীবনের পথে নানারকম বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয়। জীবনে চলার পথে নানাজনের সাহায্য সহযোগিতার দরকার হয়। অনেকে আছেন যারা একবার দুঃসময় পার হয়ে গেলে তা আর মনে রাখেন না। এমন কি বিপদের সময় যে ব্যক্তি তাকে সহায়তা করেছিল তার কথাও ভুলে যায়। কথা মনে করে না যে সে আবার বিপদে পড়তে পারে আবার ব্যক্তির প্রয়োজন হতে পারে। যারা সংকটময় সময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান, তারাই মহৎ মানুষ। তাদের ঋণ কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ রাখা উচিত। আমাদের সমাজে অনেকে আছেন যারা নিজেদের পরোপকারী বলে দাবী করেন অথচ কারো উপকার করেন না। তারা ধন-সম্পদের ভারে বৈচিত্র্যময় জীবনের কথা ভুলে যান। পরোপকারী মনোভাব হারিয়ে ফেলেন। ঘটে যাওয়া বিপদের কথা ভুলে গিয়ে অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দেন। তাদের সচেতন হওয়া দরকার যে, বিপদ যেকোনো সময় আসতে পারে

শিক্ষা: মানুষের জীবন বড় বিচিত্র। ক্ষুদ্র এক জীবনে মানুষ নানা পরীক্ষায় পড়ে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করে। বৈচিত্র্যময় জীবনে বিপদ থেকে পরিত্রাণের অভিজ্ঞতা মানুষের ভোলা উচিত নয়

বুদ্ধি যার বল তার: ভাবসম্প্রসারণ

মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কেবলমাত্র প্রাণেরই অধিকারী নয়, একই সঙ্গে মেধা, মনন বুদ্ধিমত্তারও অধিকারী। গোটা প্রাণীকূলে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রধান কারণ তার বুদ্ধিমত্তা। সৃষ্টির সূচনা লগ্নে মানুষ প্রতিকূল প্রকৃতি বন্য জীবজন্তুর আক্রমণের কাছে অসহায় ছিল। আদিম অসহায় মানুষ জ্ঞান বুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সভ্যতার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে যাচ্ছে। কেননা সে জানে, জ্ঞান বুদ্ধির চর্চার জোরেই মানুষ আজ সভ্যতার শীর্ষে অবস্থান করছে। এটিই মানুষের সব থেকে বড় শক্তি। আপাতদৃষ্টিতে, শারীরিক শক্তির ক্ষমতা বেশী মনে হলেও বস্তুত, কৌসলি বুদ্ধিমান মানুষই অধিক শক্তিশালী। শারীরিক শক্তি দ্বারা যা অর্জন করা যায় তা অত্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, হিটলারের মতো শাসকের শারীরিক অস্ত্র শক্তির বলে ক্ষমতা লাভ করলেও পৃথিবীর ইতিহাসে তারা বরণীয় হয়ে থাকতে পারেনি বরং ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়ে তাদের নাম লেখা হয়েছে। স্বল্প সময়ের জন্য তারা গোটা পৃথিবীর শাসন ক্ষমতা নিজ হাতে নিলেও, পরবর্তীতে তারা নিন্দিত হয়েছে। তাদের অপশাসন বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। অন্যদিকে, যুগে যুগে যারা লড়াইয়ের পথ পরিহার করে, জ্ঞান বুদ্ধির চর্চা দ্বারা মানবকল্যাণে অবদান রেখেছেন, ইতিহাসে তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়েছে। শারীরিক শক্তি প্রয়োগে সমাজে, দেশে সর্বোপরি গোটা পৃথিবীতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিশৃঙ্খলা-অশান্তি লেগেই থাকে। কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যক্তি বিশৃঙ্খলতার পথ পরিহার করে বুদ্ধির জোরে সকল সমস্যার সহজ শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে পারে। জগতের সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানুষের সব থেকে বড় অস্ত্র জ্ঞান বুদ্ধিমত্তা

শিক্ষা: পরম স্রষ্টা একমাত্র মানুষকেই জ্ঞান বুদ্ধির সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছেন। নিজ নিজ বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পৃথিবীর কল্যাণ সাধনের জন্য স্রষ্টা মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। প্রত্যেকের উচিত নিজ বুদ্ধিমত্তাকে সৎপথে ব্যবহার করে মানবকল্যাণ সাধনে সচেষ্ট হওয়া

জনগণই সকল ক্ষতার উৎস: ভাবসম্প্রসারণ


একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রধানত চারটি উপাদানের যথাযথ সমন্বয় প্রয়োজন। উপাদানগুলো হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড, সার্বভৌমত্ব, সরকার জনগণ। কোনো জনগোষ্ঠী যখন একটি নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডে একটি নির্দিষ্ট সরকার গঠনের মাধ্যমে তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করে একটি বৃহত্তর সমাজ গঠন করে তখনই একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী উপাদান হচ্ছে জনগণ। জনগণই একটি দেশ পরিচালনার জন্য সরকার গঠনে মূল ভূমিকা রাখে। জনগণের যথাযথ সমর্থন ছাড়া কেউ কখনো ক্ষমতার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে না। রাষ্ট্রের সরকারই সাধারণ অর্থঃ সকল ক্ষমতার অধিকারী এবং গোটা রাষ্ট্র শাসনের ভার সরকারের উপরেই ন্যস্ত থাকে। কিন্তু সরকার এই অধিকার লাভ করে জনগণের সহযোগিতা থেকে। জনগণই আসলে সরকারের হাতে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা অর্পণ করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে জনগণ আক্ষরিক অর্থঃ েই সকল ক্ষমতার উৎস। তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন ব্যক্তিকে সমর্থন জানায় এবং তার হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে। একটি রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি উঠে আসে সাধারণ জনগণের মধ্য থেকেই। ক্ষমতার আসনে থাকাকালীন সরকার জনগণের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা না রেখে কোনো নীতি গ্রহণ করতে পারে না। জনগণের বিরোধিতার মুখে অনেক সময় সরকার তার গৃহীত সিদ্ধান্ত বাতিল বা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। একটি দেশের জনগণ সর্বদা তাদের নেতা বা সরকার কর্তৃক সম্পাদিত কাজ গৃহীত সিদ্ধান্তের গঠনমূলক সমালোচনা পরামর্শ দেওয়ার অধিকার রাখে। কোনো দেশের সরকার মূলত সেই দেশের সর্বসাধারণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে। সর্বোপরি জনগণ তাদের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় তাদের সমর্থিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে যারা জনমতের ভিত্তিতে জনকল্যাণার্থে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে তার বাস্তবায়ন ঘটায়। অতএব সার্বভৌম ক্ষমতার মূল উৎস হচ্ছে একটি দেশের জনগণ

শিক্ষা: আপাতদৃষ্টিতে সরকার জনগণের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটালেও জনগণই মূলত সরকারকে ক্ষমতা প্রদান করে। আবার একমাত্র জনগণই পারে কোনো গণবিরোধী সরকারকে ক্ষমতার আসন থেকে অপসারণ করতে

 

অসির চেয়ে মসি বড়: ভাবসম্প্রসারণ

 ,

‘অসি’ অর্থঃ াৎ তরবারি ক্ষমতার প্রতীক। আর ‘মসি’ অর্থঃ াৎ লেখার জন্য ব্যবহৃত কালি জ্ঞানের প্রতীক। ক্ষমতালিপ্সু মানুষরা অসির বলে অনেক প্রাণ বিনষ্ট করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে। কিন্তু অল্পদিনই তারা নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখতে পারে। কিছুদিনের মধ্যেই আবার সেই স্থান দখল করে নেয় অন্য কোনো ক্ষমতাপিপাসু মানুষ। এমন অনেক দৃষ্টান্ত আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই। পক্ষান্তরে মনীষীগণ মসির সাহায্যে মানবজাতির কল্যাণে অনেক সৃষ্টিশীল কর্ম লিপিবদ্ধ করে যান। যা যুগে যুগে মানুষকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ দেখায়। তাঁদের লিপিবদ্ধ চিন্তাধারা সভ্যতাকে নিয়ে যায় উৎকর্ষের পথে। আর এই উৎকর্ষের পথ ধরেই মনীষীগণ সম্মান পান মানুষের অন্তরে। অন্য কেউ তাঁদের সম্মানটি দখল করতে পারে না। এমনকি মৃত্যুর পরও তাঁরা অমলিন হয়ে থাকেন মানব সভ্যতার ইতিহাসে। কিন্তু যারা অসির বলে বলীয়ান মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে যায় মহাকালের স্রোতে। অসি আর মসির মধ্যে যুদ্ধে মসি হেরে যাবে। কিন্তু অসির এ জয় ক্ষণিকের। শাশ্বত ন্যায় যুদ্ধে মসিই বিজয়ী। অসির ক্ষমতা ধূমকেতুর ন্যায়। এর স্থায়িত্ব খুবই কম সময়ের জন্য। কিন্তু মসির ক্ষমতা সূর্যের ন্যায়। সূর্য যেমন সৃষ্টির আদি থেকে প্রতিদিন তার নিয়মেই আলো ছড়াচ্ছে, মসিও তেমনি অনন্তকাল ধরে নীরবে মানুষকে সত্য, সুন্দর ও শান্তির পথ দেখাচ্ছে।

শিক্ষা: অসি তার ধ্বংসলীলার মধ্য দিয়ে মানবজাতিকে দুঃখের সাগরে ভাসায়। আর মসি তার ফোঁটায় ফোঁটায় গড়ে তোলে স্বপ্ন, সভ্যতাকে নিয়ে যায় সমৃদ্ধির পথে। তাই মসিই হওয়া উচিত আমাদের জীবনে চলার পথের পাথেয়।

 

স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন: ভাবসম্প্রসারণ

স্বাধীনতা অর্জন করা সহজ নয়। স্বেচ্ছায় কেউ স্বাধীনতা পায় না। সংগ্রামের মাধ্যমে তা অর্জন করতে হয়। কিন্তু তদপেক্ষা বেশি সংগ্রামী, সতর্ক ও সৃষ্টিশীল হতে হয় স্বাধীনতা রক্ষায়।

স্বাধীনতা অর্জন করা কোনো পরাধীন জাতির পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু সেই অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করা আরও কঠিন কাজ বলে বিবেচিত হয়। স্বাধীনতা লাভ অত্যন্ত গৌরবের ব্যাপর। কিন্তু তা খুব সহজে লাভ করা যায় না। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বহু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এবং বহু রক্তপাতের ফলেই স্বাধীনতা আসতে পারে। কারণ, শক্তিমদমত্ত শাসকেরা কখনোই পদানত জাতিকে স্বাধীনতা দান করে না; রক্তপাতের মাধ্যমেই তা অর্জন করতে হয়।

তবে স্বাধীনতা অর্জিত হলেই তা চিরস্থায়ী হয় না। স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য আরও বেশি শক্তির প্রয়োজন। কারণ স্বাধীন দেশের ভেতরে ও বাইরে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি থাকে। সকলের হিংসাত্মক দৃষ্টি থেকে দেশকে রক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধীরা ও শত্রুরা অদৃশ্যভাবে দেশের ক্ষতি করে। তাদের পরাভূত করা দুরূহ ব্যাপার। যথেষ্ট সচেতন ও সংঘবদ্ধ না হলে স্বাধীনতাকে রক্ষা করা যায় না। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য স্বাধীনতাকে মর্যাদা দিতে হয় এবং সদা সতর্ক থাকতে হয়।

স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে যেমন নির্ভীক যোদ্ধা হয়ে অস্ত্র হাতে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। তেমনি স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে কলম, কাস্তে হাতুড়ি নিয়ে অপেক্ষাকৃত কঠিন সংগ্রামে একতাবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে। তাহলেই স্বাধীনতা রক্ষা করা সহজ হবে।

 নগণই সকল ক্ষতার উৎস : ভাবসম্প্রসারণ


একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রধানত চারটি উপাদানের যথাযথ সমন্বয় প্রয়োজন। উপাদানগুলো হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড, সার্বভৌমত্ব, সরকার ও জনগণ। কোনো জনগোষ্ঠী যখন একটি নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডে একটি নির্দিষ্ট সরকার গঠনের মাধ্যমে তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করে একটি বৃহত্তর সমাজ গঠন করে তখনই একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী উপাদান হচ্ছে জনগণ। জনগণই একটি দেশ পরিচালনার জন্য সরকার গঠনে মূল ভূমিকা রাখে। জনগণের যথাযথ সমর্থন ছাড়া কেউ কখনো ক্ষমতার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে না। রাষ্ট্রের সরকারই সাধারণ অর্থঃ ে সকল ক্ষমতার অধিকারী এবং গোটা রাষ্ট্র শাসনের ভার সরকারের উপরেই ন্যস্ত থাকে। কিন্তু সরকার এই অধিকার লাভ করে জনগণের সহযোগিতা থেকে। জনগণই আসলে সরকারের হাতে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা অর্পণ করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে জনগণ আক্ষরিক অর্থঃ েই সকল ক্ষমতার উৎস। তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন ব্যক্তিকে সমর্থন জানায় এবং তার হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে। একটি রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি উঠে আসে সাধারণ জনগণের মধ্য থেকেই। ক্ষমতার আসনে থাকাকালীন সরকার জনগণের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা না রেখে কোনো নীতি গ্রহণ করতে পারে না। জনগণের বিরোধিতার মুখে অনেক সময় সরকার তার গৃহীত সিদ্ধান্ত বাতিল বা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। একটি দেশের জনগণ সর্বদা তাদের নেতা বা সরকার কর্তৃক সম্পাদিত কাজ ও গৃহীত সিদ্ধান্তের গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ দেওয়ার অধিকার রাখে। কোনো দেশের সরকার মূলত সেই দেশের সর্বসাধারণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে। সর্বোপরি জনগণ তাদের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় তাদের সমর্থিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে যারা জনমতের ভিত্তিতে জনকল্যাণার্থে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে ও তার বাস্তবায়ন ঘটায়। অতএব সার্বভৌম ক্ষমতার মূল উৎস হচ্ছে একটি দেশের জনগণ।

শিক্ষা: আপাতদৃষ্টিতে সরকার জনগণের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটালেও জনগণই মূলত সরকারকে ক্ষমতা প্রদান করে। আবার একমাত্র জনগণই পারে কোনো গণবিরোধী সরকারকে ক্ষমতার আসন থেকে অপসারণ করতে।

 

মিত্রত্ব সর্বত্রই সুলভ, মিত্রত্ব রক্ষা করাই কঠিন : ভাবসম্প্রসারণ     

মূলভাব : চলমান জীবনে মিত্রত্ব অপরিহার্য। যথার্থ মিত্রত্বই কোন জাতিকে সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে দেয়। কিন্তু সেই মিত্রত্ব ধরে রাখাটাই অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।         

সম্প্রসারিত ভাব : রক্তের বন্ধনের বাইরে মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে প্রীতির বন্ধনে, বন্ধুত্বের বন্ধনে। নানা কাজে নানা পরিস্থিতিতে অনেকের সঙ্গেই মানুষের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মানুষের জীবনে বন্ধু পাওয়া যায় অনেক, এবং খুব সহজেই। কিন্তু তার মধ্যে প্রকৃত বন্ধু যেমন অনেক কম তেমনি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে আরো কম।    মানুষের জীবনে প্রায় সময়ই বন্ধুত্ব হয় ক্ষণস্থায়ী ও উদ্দেশ্যনির্ভর। একই সমস্যায় ভারাক্রান্ত মানুষ সমস্যা উত্তরণে একে অন্যের বন্ধু হয়ে উঠে। সে বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে সমস্যা কেটে গেলেই। কখনো কখনো মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্য থেকে। উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলেই সে বন্ধুত্বে চির ধরে। এক ধরনের স্বার্থপর মানুষ আছে যারা বিত্তবান লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বৈষয়িক সুবিধা প্রাপ্তির আশায়। যতদিন স্বার্থপূরণের আশা থাকে ততদিন টেকে এ বন্ধুত্ব। বত্তবানের দুঃখ ও বিপদের দিনে এসব সুবিধাবাদী বন্ধুর দেখা মেলে না। এ ধরনের বন্ধুত্ব বা মিত্রতা একতরফা ও স্বার্থপরতা-নির্ভর। পক্ষান্তরে যে বন্ধুত্ব সাময়িক তা সার্থপরতা চিহ্নিত নয়। আত্মিক বন্ধন ও পারস্পরিক প্রীতি যে বন্ধুত্বের ভিত্তি সে বন্ধুত্বই প্রকৃত বন্ধুত্ব। এ ধরনের বন্ধুত্ব সুসময়ে গড়া দুঃসময়ে ভাঙা বন্ধুত্ব নয়। সময়ের ঘাত-প্রতিঘাতের কষ্টিপাথরে নিখাদ হতে পারলেই গড়ে উঠতে পারে এ ধরনের প্রকৃত বন্ধুত্ব।    সময়ের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই কেবল এ ধরনের বন্ধুত্ব পায় প্রকৃত বন্ধুত্বের মর্যাদা। এ ধরনের বন্ধুত্ব রক্ষা করা খুব সহজ কাজ নয়। এ ধরনের বন্ধুত্ব রক্ষা করতে হলে পরস্পরকে হতে হয় একান্তভাবে সহমর্মী। পরস্পরের প্রতি থাকা চাই গভীর আস্থাও বিশ্বাস। তা না হলে ভুল বোঝাবুঝির কারণে বন্ধুত্বে ফাটল বা ভাঙন ধরতে পারে। এ ধরনের বন্ধুত্বে দু পক্ষকেই হতে হয় স্বার্থত্যাগী পরার্থপর। পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসই রচনা করে এ ধরনের বন্ধুত্বের সেতুবন্ধুন। প্রতিটি অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই প্রকৃত বন্ধু টিকে থাকে এবং মহিমা পায়।    প্রচেষ্টার দ্বারা মানুষ এক সময় তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছাবেই। 

 

প্রয়োজন ব্যতিত বন্ধু ও শত্রু চেনা যায় না : ভাবসম্প্রসারণ

মানুষ সামাজিক প্রাণী বলে একাকি বাস করতে পারে না। তাকে সমাজে বাস করতে হয়। জন্মের পর থেকেই মানুষ অসহায়। সংগ্রাম করে তাকে জীবনযাপন করতে হয়। জীবন সংগ্রামের পথে মানুষকে সমাজের মানুষের সাথে মিশতে হয়। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে কারো কারো সাথে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠে। যারা প্রকৃত বন্ধু, শুভাকাঙ্খী তারা মানুষের ভালো চায়, কল্যাণ কামনা করে। আর যারা শত্রু তারা অপরের অমঙ্গল কামনা করে, ক্ষতি করার চেষ্টা করে। মানুষের জীবনে সুসময় এবং দুঃসময় পর্যায়ক্রমে আসে। সুসময়ে বন্ধু এবং শত্রু কাউকে চেনা যায় না। সবাই তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বন্ধুত্বের বুলি শুনায়। মানুষ যখন বিপদে পড়ে, যখন প্রয়োজন হয়, তখন বন্ধুত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রকৃত বন্ধুরা বিপদের সময় কখনও ছেড়ে যায় না। যারা বিপদের মুখে বন্ধুকে রেখে পালিয়ে যায় তারা বন্ধুরূপী শত্রু। তারা বসন্তের কোকিলের মতো জীবনে আসে। তারা আসে শুধু তাদের প্রয়োজনেই। তারা আসলেই স্বার্থপর। এসব স্বার্থপর লোক বন্ধু হতে পারে না। স্বার্থপর বন্ধু ও শত্রু দুর্দিনে বা সংকটকালে স্পষ্ট হয়ে যায়। তারা বিপদের সময় এগিয়ে আসে না, বরং বিপদে ফেলে চলে যায়। একমাত্র প্রয়োজনের সময়ই বন্ধু ও শত্রু আলাদাভাবে নিরূপন করা যায়। প্রয়োজনই বন্ধু ও শত্রু চেনার পরিমাপক।

শিক্ষা: বন্ধু নির্বাচন করতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বন্ধু জীবনে চলার পথে অপরিহার্য অঙ্গ। অপ্রকৃত বন্ধুদের থেকে দূরে থাকতে হবে।

 

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে। মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই?

পৃথিবীতে প্রেম-প্রীতি,স্নেহ-ভালোবাসা, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে প্রত্যেক মানুষই সম্পর্কের বেড়াজালে বন্দী। মৃত্যুকে সত্য জেনেও মানুষ সেই বেড়াজাল ছিন্ন করতে চায় না। পারস্পরিক বন্ধন মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়। বিশ্বপ্রকৃতির মাঝে মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। পৃথিবীর সৌন্দর্যের মাঝে সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির কোলে মানুষ হেসে খেলে বেড়ে উঠেছে। আনন্দ-বেদনা নিয়ে পরস্পরের সাথে মিশেছে। জগতের বিচিত্র কর্ম কোলাহলে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। চিরচেনা, চির আনন্দ ও চির বসন্তের সেই জীবন ছেড়ে সে যেতে চায় না। মানুষ পৃথিবীতে যে সৌন্দর্য উপভোগ করে, মায়ার বন্ধনে জড়ায়, তা ছিন্ন করে কোথাও যেতে চায় না। জগতের মোহ মানুষ কিছুতেই ত্যাগ করতে পারে না। ব্যক্তি, সমাজ ও প্রকৃতির মায়ার জালে সে আবদ্ধ হয়ে পরে। মৃত্যু নামক অমোঘ সত্যের প্রতি তার বিতৃষ্ণা জন্ম নেয়। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর প্রেম তাকে বিমোহিত করে রাখে। এ জগৎ সংসারই মানুষের কাছে স্বর্গরূপে রূপায়িত হয়। তাই পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে মানুষ মৃত্যুর কথা ভুলে মানুষের মাঝে চির অমর হয়ে থাকতে চায়।

শিক্ষা: মানুষ মরণশীল। অবশ্যম্ভাবী এই পরিণাম সম্পর্কে সচেতন থেকেও মানুষ পৃথিবীকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে চিরকাল পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়। তবে মানুষ তার কর্মের মধ্য দিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে।

 মা এবং মায়ের মুখের ভাষা দুটোর মূল্যই সমান?

মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। ভাষা না থাকলে সুন্দরভাবে মনের কথা অন্যের কাছে বলা সম্ভব ছিল না। মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি প্রতিটি মানুষের কাছেই অমূল্য সম্পদ। যেকোনো সন্তানের কাছে মায়ের ঋণ অপরিশোধযোগ্য। সন্তানকে লালন পালন করতে গিয়ে একজন মা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন। সন্তাানের মঙ্গল কামনায় নিরলস সেবা যত্ন করেন। তাই সন্তানের কাছে মা সব সময়ই মঙ্গলময়ী, স্নেহময়ী, মহিমাময়ী। তেমনি মাতৃভাষাও মানুষের অস্তিত্বের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। মা ছাড়া কোন শিশুর জীবন কখনও পরিপর্ণ হয় না। তেমনি মাতৃভাষা ছাড়াও কোন জাতির পূর্ণ পরিচয় ফুটে উঠে না। বিদেশী ভাষায় কথা বলে মনের শান্তি পাওয়া যায় না। এ জন্যই পৃথিবীর সকল জাতি তার মাতৃভাষা চর্চা করে থাকে। মায়ের অমর্যাদা বা অপমান যেমন কোন সন্তান সহ্য করতে পারে না তেমনি মাতৃভাষার অপমানও কোনো জাতি মেনে নেয় না। তাই ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা দাবিতে প্রাণ দিতেও পিছপা হয়নি এদেশের সাহসী সন্তানেরা। আর এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিদেশী ভাষা কখনও কারো মন ও প্রাণের মুক্তি দিতে পারে না। মানুষ কথা বলে মায়ের ভাষায়, স্বপ্ন দেখে মায়ের ভাষায়; তাই মাতৃভাষা অদ্বিতীয়। মায়ের কাছে যেমন সন্তান তৃপ্তি পায়, তেমনি মাতৃভাষাও যে কোন জাতির জাতীয় পর্যায়ে পরিতৃপ্তির অন্যতম উৎস।

শিক্ষা: প্রত্যেক জাতি যেমন মায়ের কাছে ঋণী। তেমনি মাতৃভাষার কাছেও ঋনী। মা জন্মদান করে আর মাতৃভাষা বিশ্ব দরবারে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে। সকল জাতি এবং সভ্যতা মা এবং মায়ের ভাষার প্রতি কৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাশীল থাকা আবশ্যক।

 

ভূতের ভয় অবিশ্বাসে কাটে না

মূলভাব : ভয় হল মানুষের মনের ব্যাপার। নিজের উপর যদি মানুষের আস্থা না থাকে তাহলে কোন কাজই নিজেকে দিয়ে সম্ভব হয় না। কিন্তু যদি সত্যিই দুর্বলতা থাকে তাহলে নিজের উপর যতই বিশ্বাস বা আস্থা থাকুক না কেন সেটির সফলতা আসে না। 

সম্প্রসারিত ভাব : ভয়, আতঙ্ক এসব কিছুর কেন্দ্রস্থল হল মানুষের মন। মানুষের মনই হল সবচেয়ে অনুভূতিপূর্ণ। যে কোন ধরনের আশাআকাঙ্ক্ষা, হতাশা, নিরাশা, ভয় সেখানে জাগ্রত হয়। এ জাগরণটা যদি বেশি মাত্রায় হয় তাহলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এবং কার্যপ্রণালীর উপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এটি প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যক্তিকে কোন কাজে এগিয়ে অথাব পিছিয়ে দেয়। আর ব্যক্তি যখন পিছিয়ে যায় তখন তার ব্যর্থতা স্বীকার করা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। কিন্তু ব্যর্থতার ছাপ যদি সত্যিই কারো উপর পড়ে, তাহলে সে যতই নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গঠনের চেষ্টা করুক না কেন সে ব্যর্থ হবেই। কারণ মনের দুর্বলতা দূর করতে কেবল সাহস আর আত্মবিশ্বাসই যথেষ্ট নয়। তার জন্য দরকার আপন দুর্বলতাকে আগে সবল করে তোলা। যদি নিজেই সবল না হয়, তাহলে যে কোন সহজ কাজকেই কঠিন মনে হবে। আর স্বাভাবিক নিয়মেই সেই কাজটি করা দূরুহ হয়ে উঠবে। 

মূলত নিজে শক্ত সমর্থ না হলে সবসময়ই নিজের মধ্যে একটা লুকায়িত ভয় কাজ করবে, যা প্রতিটা মুহূর্তেই পিছুটান দিবে। কিন্তু নিজের মধ্যে এ লুকায়িত ভয় নেই, তা যতই অবিশ্বাস করা হোক না কেন, সে ভয় কখনওই দূরীভূত হবে না।

বড়র পিরীতি বালির বাঁধ

মূলভাব : জগৎ বিচিত্র। এখানে বিচিত্র মানুষের বাস। বড়-ছোট, ধনী-দরিদ্র মানুষের চারণভূমি আমাদের এ পৃথিবী। আশা-আকাঙ্ক্ষা ভালোবাসার মাধ্যমে ছোট বা হীন শ্রেণীর প্রত্যাশা থাকে বড়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তা বাস্তবে রূপ নেয় না। 

সম্প্রসারিত ভাব : মানব সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমাদের দৃষ্টিগোচর হবে যে, মান-সম্মান, সামাজিক প্রতিপত্তি, ধন-সম্পদ ইত্যাদির দিক থেকে মনুষ্য জাতির মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান বিদ্যমান। আর এ ব্যবধান স্পষ্ট হয়ে উঠে তাদের আবাসস্থল, আচার-আচরণ, সাজ-সজ্জা, চলাফেরা, সুযোগ সুবিধা ভোগ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। এ সমাজে প্রতিটি মানুষ এক একটি ভারসাম্য অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু এ অবস্থার ব্যতিক্রম হলেই ঘটে বিপত্তি। আমাদের সমাজে কিছু তথাকথিত ধনী শ্রেণী আছে যারা নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দরিদ্র শ্রেণীর লোকদের ব্যবহার করে। আর ঐ সময়ে দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা ধনী শ্রেণীর লোকদের কৃত্রিম আচরণে মুগ্ধ হয়ে তাদেরকে আপন ভাবতে শুরু করে। সে তার নিজের অবস্থাকে ভুলে যায়। সে আবেগের বশবর্তী হয়ে কঠিন বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে চায়। সে এ কথা ভুলে যায় যে, তেল এবং জল যেমন কখনও মিশে না তেমনি ধনী-দরিদ্র কখনও এক হতে পারে না। তথাকথিত এ ধনী শ্রেণীর স্বার্থ সিদ্ধি হলেই তাদের প্রকৃত আচরণ ফুটে উঠে। আর তখনই কঠিন বাস্তবতা ঐ দরিদ্র শ্রেণীর কাছে ধরা দেয় এবং তাকে আবার নিজ স্থানে ফিরে আসতে হয়। মূলত অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় দরিদ্র শ্রেণীর প্রতি তথাকথিত ধনী শ্রেণীর মানুষের ভালোবাসা বালির বাঁধের মত। বালির বাঁধ যেমন ঢেউ এলই ভেঙে পড়ে, তেমনি স্বার্থ সিদ্ধি হলেই ধনী শ্রেণীর ভালোবাসা আর থাকে না। তাই প্রত্যেকটা মানুষের উচিত তাদের নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করা। কেননা এ ভারসাম্যের ব্যতিক্রম ঘটলেই দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে।

মানব সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে যে বারসাম্য রয়েছে তাকে আমরা অস্বীকার করতে পরি না। বরং আমাদের উচিত নিজ নিজ অবস্থানে থেকে চিন্তা এবং কাজ করা।

বিদ্যা যতই বাড়ে ততই জানা গেল যে, কিছুই জানা হল না 

মূলভাব : বিদ্যার্জন মানুষের জন্য একটি সার্বক্ষণিক চলমান প্রক্রিয়া। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ নতুন নতুন বিষয়ের সাথে পরিচিত হতে থাকে এবং এভাবে জ্ঞানার্জনেরও নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হতে থাকে। 

সম্প্রসারিত ভাব : কেউ কোন একটি ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞানার্জন-করলেও তার জন্য নতুন আরেকটি ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে থাকে। এভাবে জ্ঞানার্জনের চলমান প্রক্রিয়ায় মানুষের জ্ঞান যত বাড়ে ততই তার ক্ষেত্র প্রসারিত হতে থাকে এবং এ প্রসারণের পরিধি এতই ব্যাপক যে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের জ্ঞানার্জনের পিপাসা থেকেই যায়। কেউ হয়তো কোন একটি বিষয়ে জ্ঞানার্জনের পর সাময়িকভাবে নিজেকে জ্ঞানী ভাবতে পারে, কিন্তু এ জ্ঞানই তাকে আবশ্যিকভাবে জ্ঞানের নতুন দিগন্তে নিয়ে যাবে এবং এ দিগন্ত নবতর জ্ঞানার্জনের ফলে এত প্রসারিত হতে থাকবে যে, তিনি যতই জানুন, প্রতিদিনই ভাববেন যে, আসলে তার কিছুই শেখা হয়নি। বিজ্ঞানী নিউটন বলেছিলেন, আমি এতদিন কেবল জ্ঞানসমুদ্রের তীরে নুড়ি পাথর কুড়িয়েছি, জ্ঞানসমুদ্রে এখনো আমার নামা হয়নি। জ্ঞানার্জনের কোন শেষ নেই। প্রকৃতির বিশাল ব্যাপ্তি এবং মানুষের জানার ক্রমযোজিত আগ্রহই জ্ঞানেই এ পরিধিকে ক্রমশ ব্যাপ্ত করতে থাকে। মানুষ যত জানে ততই বেশি পরিমাণে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠে। তখন তার জ্ঞানপিপাসা প্রবল হতে থাকে এবং জ্ঞানার্জনের নতুন পথে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশনা প্রদান করে। চলমান এ প্রক্রিয়ায় জ্ঞানার্জনের পথ পরিক্রমায় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ বিরামহীন ধাবিত হতে থাকে। ধাবিত হওয়ার এ প্রক্রিয়ায় জ্ঞানার্জনের পথে কতটা ধ্রুততার সাথে ধাবিত হতে পারে তা ব্যক্তির জ্ঞানার্জনের মাত্রার উপর নির্ভর করে। অতএব যে যত বেশি জানবে সে তত বেশি নবতর জ্ঞানের জন্য অগ্রসর হতে পারে। সুতরাং, জ্ঞানার্জনের কোন শেষ নেই এবং কোন জ্ঞানই চূড়ান্ত নয়।

যৌতুক প্রথা এক সামাজিক ব্যাধি 

মূলভাব : সমাজে প্রচলিত প্রথাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হচ্ছে যৌতুক প্রথা। এটা ভয়ানক ব্যাধির মত সমাজের মানুষকে পচন ধরিয়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে উন্মোচিত করে। নারীর মানবিক সত্তাকে অবমূল্যায়িত করে মানব সভ্যতাকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। তারা ভুলে যায়- 

’এ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর 

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ 

সম্প্রসারিত ভাব : মানব সভ্যতা বিকাশে নারী-পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। পুরুষের পক্ষে নারীর সাহায্য ছাড়া কোন কিছুই করা সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও আমরা মধ্যযুগীয় বর্বর চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পরি না। যে নারী ছাড়া আমাদের ঘর গেরস্থালীর সমস্ত কিছু অচল হয়ে পড়ে। বিপদে দিশেহারা হয়ে পড়ি। সেই নারীকে আমরা আজো পশুর মত কেনা-বেচা করি। দাম্পত্য সম্পর্কের মত এমন একটা মধুর সম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে আমরা অর্থ-বৃত্ত চেয়ে বেসি রাঘব-বোয়ালের মত। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার টুটি চেপে ধরে কেড়ে নিয়ে আসি যতদূর সম্ভব। বিয়ের নামে প্রচলিত এ কেনা-বেচার প্রথাকেই বলা হয় পণপ্রথা বা যৌতুক প্রথা। যার বলি হচ্ছে আমাদের সমাজের অধিকাংশ নারী। যৌতুকের দায়বদ্ধতা এড়ানো ভিটেমাটি বিক্রি করতে হয় দরিদ্র পিতাকে। যৌতুক প্রদানের ব্যর্থতায় সংসার ভাঙ্গে নব বধূর। মধুর স্বপ্ন বিষিয়ে উঠে জীবনের শুরুতেই অত্যাচারিত হয়ে আত্ম-বিসর্জনের পথও বেছে নিতে হয় অনেককে। পত্রিকা খুললেই যার প্রমাণ আমাদের দেশে দৈনিক আর দশটা সাধারণ সংবাদের মতোই পাওয়া যায়। কবে কে, কোথায়, কিভাবে এ ভয়ানক ব্যাধিরূপী সামাজিক প্রথা সৃষ্টি করেছিল যা আমাদের দেশ, জাতি, সমাজ আজ সভ্যতার চরম শিখরে এসেও পরিত্যাগ করতে পারেনি। সত্যিই এ বড় লজ্জার ব্যাপার। মানুষ যেমন ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তা ক্রমেই বেড়ে চলে, তার হাত থেকে কোনক্রমেই পরিত্রাণ লাভ করা যায় না, যৌতুক নামক ভয়ানক এ সামাজিক ব্যাধি থেকেও তেমনি আমরা কেউই রেহাই পাচ্ছি না। একবার যেমন নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, তেমনি অন্যকে অত্যাচারিত করছি। আসলে এ সামাজিক ব্যাধিটি আমাদের মানসিকতায়ও পচন ধরিয়েছে। এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। তা না হলে মানবতার অপমানের পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন সর্বাগ্রে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন এবং বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন। বিশেষ করে নারীদেরকে সচেতন করে তোলা। 

নারীর মূল্যবোধ জাগ্রত করা, তাদেরকে স্বাবলম্বী করে তোলা এবং অধিকার সচেতন করে তোলার মাধ্যমেই এ ব্যাধির চিকিৎসা করতে হবে। তা না হলে এর কালো থাবা থেকে আমরা কেউই মুক্তি পাব না। কারণ এটা সত্যিই এক ভয়ানক ব্যাধি।

যত মত, তত পথ     

মূলভাব : পৃথিবীতে বিভিন্ন মত ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে এটা স্বাভাবিক। মত আর দৃষ্টিভঙ্গির এ ভিন্নতাহেতু মানুষের জীবন এবং কর্মের ভিন্নতাও খুবই স্বাভাবিক বিষয়।          

সম্প্রসারিত ভাব : সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষের মধ্যে ভিন্নতার বিষয়টি বিদ্যমান। মানুষ চিন্তা চেতনা আর দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাসের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই পরস্পর থেকে ভিন্ন হতে পারে। এ ভিন্নতা তাদের জীবনাচার, ধর্মকর্ম ও লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয়। এক ধর্মে বিশ্বাসী বা অনুসারীদের জীবনাচার, চালচলন, রীতি নীতি অন্যদের চেয়ে ভিন্ন হবে। কেননা, মত ও বিশ্বাসের ভিন্নতার সাথে জীবনের বাহ্যিক ও আত্মিক অনেক বিষয়ই জড়িত। ব্যক্তির জীবনাচার ও কর্মের মাঝে তার মতের প্রতিফলন ঘটতে পারে। মতের ভিন্নতার কারণে যে পথেরও ভিন্নতা হতে পারে এ সত্যটাকে যখন মানুষ উপলব্ধি করতে পারে তখন ভিন্নতার মাঝেও ঐক্যের সুর শোনা যায়; পারস্পরিক সহনশীলতার মাধ্যমে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যায়। কেননা মানুষ যখন বুঝতে পারে, তার নিজের যেমন একটা মত বা একটা বিশ্বাস আছে এবং সে মত ও বিশ্বাস তাকে একটা নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করে, তেমনি অন্যের ক্ষেত্রেও তা স্বাভাবিক। এবং তখন তার মাঝে এসব কিছু মেনে নেওয়ার মনোবৃত্তি জন্ম নেয়। এমনিভাবে সকল মানুষের মাঝে এরূপ মনোবৃত্তির বিকাশ হলে অনেক ভিন্নতার মাঝেও মানব সমাজে শান্তির ধারা প্রবাহিত হতে পারে। কিন্তু যখনই এর ব্যতিক্রম ঘটে তখনই দেখা যায় এক ধর্ম আর বর্ণের মানুষ অন্যদের সহ্য করতে চায় না। শুরু হয় সাম্প্রদায়িক রেষারেষি, বিনষ্ট হয় মানব সমাজের শান্তি আর সমৃদ্ধি। মানুষের নিজের মতকে অপরের উপর চাপিয়ে দেওয়ার নীচু মনোবৃত্তি তাকে যেমন করে তোলে উগ্র, তেমনি সেও অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের মুখোমুখী হয়। যুগে যুগে মানব জাতিকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে এবং বর্তমানেও বিশ্বের আনাচে-কানাচে মানুষকে তার মাশুল গুণতে হচ্ছে। শক্তিশালী জাতি, ধর্ম আর বর্ণের মানুষ নিজের মতকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য তৎপরতা আজো থামায়নি, বরং প্রতিনিয়ত এর জন্য নানা ফন্দিফিকির আবিষ্কার করছে।   

 মানব সমাজ থেকে এ ঘৃণ্য প্রবৃত্তির উচ্ছেদ যতদিন সম্ভব না হবে ততদিন মানবজাতিকে এর মূল্য দিতেই হবে। মনে রাখতে হবে দিন শেষে আমরা সকলেই একই গ্রহের মানুষ। 

যৌবনে অর্জিত সুখ অল্প, কিন্তু সুখের আশা অপরিমিত

মূলভাব : মানবজীবন সময়ের হিসেবে খুবই হ্রস্ব। কিন্তু এ স্বল্প সময়ের পরিসরেও তাতে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য ও পরিবর্তন। 

সম্প্রসারিত ভাব : শৈশব, কৈশোর যৌবন, বার্ধক্য-এ রকম অনেক ধাপ বা স্তর রয়েছে মানবজীবনের। এর মধ্যে যৌবন কাল নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ সময়। এ সময় মানুষ আবিষ্কার করে নিজেকে। তার ভেতরের নানা সম্ভাবনা, সৌন্দর্য, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, উন্মাদনা প্রবলভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে। শৈশবে মানুষ থাকে অসহায়, অন্যের উপর নির্ভর করে তার জীবন মরণ। কৈশোরে দেহমন ধীরে ধীরে পর্ণাঙ্গতা পেতে থাকে। বার্ধক্যে শরীর, মন ও কর্মশক্তি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। শুধুমাত্র যৌবনের মানুষ শক্তি, শরীর ও মনের পূর্ণাঙ্গতা পায়। জীবন অমিত সম্ভাসনায় আধার হিসেবে প্রতিভাত হয় এবং মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশাল কর্মযজ্ঞে। তার মন সুখ প্রত্যাশী হয়ে উঠে এবং এ সুখের পেছনে সে তৃষ্ণার্ত হরিণীর মত ছুটতে থাকে। তার কাজকর্ম, চিন্তা-চেতনা, লক্ষ্য সবই ধাবিত হয় সেই সুখের দিকে। কিন্তু সুখ নামক সোনার হরিণ এ সময় খুব কমই ধরা দেয়। জীবনের জটিলতা, কর্মব্যস্ততা ও বৈচিত্র্যময় ব্যাপ্তির কারণে এ সময় সুখ অর্জিত হয় খুবই কম। 

মানুষ যেহেতু কল্পনাবিলাসী ও সুখের মায়ায় আবদ্ধ এক সজ্ঞান জীব এবং যৌবন যেহেতু জীবনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সময়, সেহেতু তার ভেতর সুখের আকাঙ্ক্ষা খুব তীব্রভাবে বিরাজ করে।

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে। 

তবে একলা চল, একলা চল রে। 

মূলভাব : স্রষ্টার বিচিত্র সৃষ্টি মানুষ। এ মানুষের জীবন ছোট বড় কাজের সমষ্টিতে গড়া ভগবদগীতায় আছে, অবিরাম কাজ করতে হবে। সব কাজই ভালোমন্দ মেশানো। আমরা এমন কোন কাজ করতে পারি না, যাতে কোন না কোন উপকার হবে না, এমন কোন কাজ নেই, যাতে কোথাও কোন ক্ষতি হবে না। তবু আমাদের অবিরাম কাজ করে যেতে বলা হয়েছে। 

সম্প্রসারিত ভাব : ভালো মন্দ দুয়েরই ফল দেখা দেবে, দুয়েরই কর্মফল হবে, সৎ কাজ আমাদের ভালো ফল দেবে, অসৎ কাজ খারাপ ফল দেবে। শুভকর্ম কল্যাণধর্মী ও সৃষ্টিশীল। অপরদিকে অশুভকর্ম অকল্যাণকামী, ধ্বংসাত্মক। প্রকৃত মনুষ্যত্বের সাক্ষর রাখতে গেলে শুভকর্ম পথেই আমাদের বিচরণ করা উচিত। আর এ চলার পথে বাধা-বিঘ্ন থেকে পরিত্রাণের জন্য আমরা অপরের সাথে, সহায়তা কামনা করি। কিন্তু বাস্তবে মানবকল্যাণকর্মের সঙ্গী বা সাহায্যকারী হিসেবে সহজে কাউকে পাওয়া যায় না। ভালো কাজের সাথে বহুকে মেলানো তাই এক অসাধ্য ব্যাপার। তাই সৎ কাজে ব্রতী মানুষকে প্রায় নিঃসঙ্গভাবে এগিয়ে যেতে হয়। মানবকল্যাণে দ্বিধাহীন চিত্তে তিনি এগিয়ে চলেন বলেই অর্জিত সাফল্য তার জীবনে আনে তৃপ্তি, দৈবাৎ অসাফল্যেও আনন্দের ঘাটতি ঘটে না। 

তাই যিনি কল্যাণকর্মে উদ্যোগী তার আহ্বানে কেউ সাড়া দিক বা না-ই দিক আপন কর্তব্যকর্মের লক্ষ্যে তাকে একাই এগিয়ে চলতে হবে।

শীত যদি এসে যায়, বসন্ত কোথায় রয়

মূলভাব : ছয়টি ঋতু পালাক্রমে আবর্তিত হয়। এক একটি ঋতু আপন ঐশ্বর্যে মহিমামন্ডিত। কিন্তু তার পরেও একটি ঋতু বিদায়ের কালে আত্মত্যাগের মাধ্যমে আরেকটি ঋতুর জন্য রেখে যায় প্রেরণার ঝর্ণাধারা, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। 

সম্প্রসারিত ভাব : গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত -এ ষড়ঋতু চক্রে প্রথমে বর্ষাযাত্রা আবর্তিত। একটি ঋতু পরেরটির জন্য আত্মদান করে, নিজের মধ্যেই জাগিয়ে তোলে আরেকটির সম্ভাবনা- এ হল প্রকৃতির নিয়ম। গ্রীষ্মের পরে যেমন বর্ষা এবং তারপরে শরৎ আসবেই তেমনি শীতের পরে বসন্তের আগমন অনিবার্য। তাই খর বৈশাকে প্রকৃতি যখন জ্বলতে থাকে তখন যদি কেউ ভাবে যে এ গ্রীষ্মই পৃথিবীর শেষ ঋতু এর পরে নবীন মেঘের ঘোমটা মাথায় শান্ত স্নিগ্ধ জলের ঝারি নিয়ে বর্ষারাণী আসবে তাহলে সে সম্পূর্ণ ভুল করবে। তেমনি ভুল হবে একথা ভেবেও যে পাহাড়ি দেশের হিমেল পরশ নিয়ে উত্তর পবন যখন জীব জগতের দুঃখ বয়ে আনবে, সে দুঃখের কোনো শেষ নেই। বরং উলটো কথাটাই ঠিক। ফাল্গুনের উজ্জ্বল প্রভাবে শীত-বায়ুর হি-হি করা আর্তনাদ হয় পরাভূত। মলয় পবনের রথে চড়ে হাতে নতুন ফুলের গুচ্ছ আর পাগল করা গানের সম্ভাবনা নিয়ে যায় আবির্ভাব হয় সে ঋতুরাজ বসন্ত। গভীর প্রত্যয়ে শেলীকে তাই বলতে শুনি, If winter comes can the spring be for behind? শীত যদি আসে বসন্ত কি দূরে থাকে? 

প্রকৃতি রাজ্যের এ সত্যটিকে আমরা মানবজীবনেও দেখতে পাই। সাময়িক দুর্যোগে আমরা যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি তখন স্বাভাবিক দুর্বলতাবশেই একথা ভাবি যে এ দুর্ভাগ্যের বুঝি আর শেষ নেই। কিন্তু এ অবস্থা কখনও স্থায়ী হতে পারেনা। বরং প্রভাতের পূর্বে যেমন গভীর রাত্রির অন্ধকার বিরাজমান তেমনি আনন্দের আগেও একটি বেদনার দিন যদি আসে তাতে নিরাশ হবার কিছু নেই। দুঃখের বিষ পান করতে পারলেই অমৃতময় সুখের দিন আসে। রবীন্দ্রনাথের গানে আছে- “দুঃখের মথন বেগে উঠিবে এ অমৃত। শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।”

শিক্ষাই শক্তি শিক্ষাই মুক্তি

মূলভাব : শিক্ষা মানবজাতির জন্য এক মহার্ঘ্য বিষয়। এটা ছাড়া মানুষের মনুষ্যত্ব কখনই বিকশিত হয় না। এজন্যই সর্বত্র শিক্ষাকে অত্যন্ত আবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনকি আমাদের ধর্মেও এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে একে সকল নারী ও পুরুষের জন্য ফরজ করা হয়েছে।

সম্প্রসারিত ভাব : বস্তুত, শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং উপকারিতা এত ব্যাপক যে, এর গুণ বলে শেষ করা যাবে না। প্রাচীন কাল থেকেই দেখা গেছে, যে জাতি শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত, যে জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞান, শৌর্ষ-বীর্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তি তত বেশি। প্রাচীন গ্রিক জাতি তাদের শিক্ষাদীক্ষার জন্যই আজও আমাদের কাছে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। আর আজকের পৃথিবীর এ যে প্রগতি ও প্রাচুর্য, তার মূলেও রয়েছে শিক্ষার বিস্তৃত প্রভাব। প্রকৃত প্রস্তাবে শিক্ষার বহুমুখী প্রভাব আমাদের জীবনে বিদ্যমান এবং আমাদের জীবন-যাপনে সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যতীত আমরা কোনভাবে উন্নত জীবন অর্জন করতে পারবো না। বিশেষত বর্তমানে বিশ্বের প্রধান সমস্যা ক্ষুধা ও দারিদ্র্য। আমরা যদি এ সবের কারণ উদ্ঘাটন করতে যাই, তাহলে দেখব এর মূলে রয়েছে অশিক্ষা বা শিক্ষার অভাব। কারণ শিক্ষা বা জ্ঞানচর্চা আমাদের বিভিন্ন সমস্যার যথার্থ সমাধানের পথের সন্ধান দেয়। বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলার কৌশল অর্জনে সাহায্য করে। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখব, মানুষ যখনই বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, তখন সে তার অর্জিত শিক্ষা বা জ্ঞান দ্বারা এর সমাধানের কৌশল উদ্ভাবন করেছে। আর এভাবেই মানুষ পৃথিবীকে একটি সুন্দর আবাসভূমি হিসেবে নির্মাণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজও বহুলাংশে মানুষ ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দ্বারা পীড়িত। কিন্তু পৃথিবীর সবাই বা সব জাতি এ সমস্যা দ্বারা পীড়িত নয়। এর কারণও শিক্ষা। আমরা দেখছি, উন্নত বা সুশিক্ষিত জাতি ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দ্বারা পীড়িত নয়।

 

তৃষ্ণার জল যখন আশার অতীত মরীচিকা তখন সহজে ভোলায়


মানুষ সমাজে বাস করে। এই সমাজ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন এর মতো মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পূরণ করে থাকে। তথাপি প্রাপ্তির মাঝেও কিছু অপ্রাপ্তি থেকে যায়। অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত চাহিদা পূরণে সমাজ ব্যর্থ হয়। আর ক্রমাগত ব্যর্থতা মানুষকে হতাশায় জর্জরিত করে তোলে। সে তার বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। তপ্ত মরুভূমিতে পথিক যখন তৃষ্ণার্ত হয় তখন সে চারদিকে হন্যে হয়ে জল খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু সূর্যের প্রখর তাপে মরুভূমিতে জল পাওয়া সহজ নয়। মরুভূমির বালিতে তীর্যকভাবে সূর্যকিরণ পতিত হলে তা দূর থেকে পানির মতো দেখা যায়, যাকে মরীচিকা বলে। পথিকের কাছে মনে হয় সামনে পানি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু যখন সে সামনে এগিয়ে যায় তখন পানির মতো দেখতে মরীচিকা আরও দূরে সরে যায়। মানুষের জীবনও এরকম মরুভূমির মরীচিকার মতো। মরীচিকার পেছনে যেমন মরুভূমির পথিক বুদ্ধি-জ্ঞানহীনের মতো ছুটতে থাকে তেমনি কাক্সিক্ষত বস্তু না পাওয়ার বেদনায় মানুষ বিবেকহীন হয়ে পড়ে। এর ফলে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। সমাজে সৃষ্টি হয় চরম বিশৃংখলা।

শিক্ষা: অভাব মানুষকে বিভ্রান্ত করে অনিশ্চিত জীবনের পথে ছুটতে বাধ্য করে। যা তাকে চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। অতিরিক্ত প্রাপ্তিও আবার মানুষকে বিপথের দিকে ঠেলে দেয়। তাই মানুষের জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি দুই-ই থাকা উচিত।

লোভে পাপ পাপে মৃত্যু    

মূলভাব : লোভ মানব চরিত্রের এক দুর্দমনীয় প্রবৃত্তি। মানুষ যখন লোভের পথে পা বাড়ায়, তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সমাজের অধিকাংশ মানুষ লোভের দ্বারা কম বেশি তাড়িত হয়। লোভ মানুষকে পাপ কাজে নিয়োজিত করে। কুপথে ধাবিত করে আর এজন্যই মানব জীবনের পরিণাম অনেক সময় দুঃখময় হয়ে উঠে, কখনও কখনও ঘটে মৃত্যু।           

সম্প্রসারিত ভাব : নিজের ভোগ-বিলাসের জন্য দুর্দমনীয় বাসনাই লোভ। আমাদের চারপাশে সর্বত্র লোভের হাতছানি। অর্থ, বিত্ত, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির প্রতি মানুষের প্রচণ্ড লোভ। লোভে মানুষ পরিণামের কথা চিন্তা না করে এমন সব কাজ করে যা আইনের চোখে দণ্ডনীয়। ফলস্বরূপ বরণ করে নেয় জীবনের করুণ পরিণতি। লোভের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ তার মা, বাবা, ভাইবোন সবাইকে অবজ্ঞা করে। স্বীয় বাসনা পূর্ণ করার জন্য সবাইকে ভুলে যেতে দ্বিধাবোধ করে না। টাকার মোহ তাকে পাগল করে তোলে। লোভ মানব জীবনের বড় শত্রু। লোভকে এজন্য পাপের আধার বলা যেতে পারে। তিনটি জিনিস মানুষকে ধ্বংস করে- লোভ, অহংকার এবং হিংসা। লোভ তাদের মধ্যে একটি। মানুষ আল্লাহর প্রিয় বান্দা এবং আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু স্বয়ং আল্লাহও লোভীদের পছন্দ করেন না। লোভ আর স্বার্থবুদ্ধির দ্বারা তাড়িত হয়ে, মানুষ ভাইকে, বন্ধুকে হত্যা করেছে। পরিণামে নিজের আত্মহননের পথ নিজেই তৈরি করেছে। এ কথা সত্য যে লোভের পথে পা দিলে একদিন তার মৃত্যু হবেই। লোভ মানুষকে জঘন্য পথে ক্রমশ তাড়িত করে। বেশি লোভ করা ভালো না। কথায় আছে- ’অতি লোভে তাঁতী নষ্ট’। আর এভাবেই লোভী ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হয়। সে অন্যায় অসত্য আর পাপের পথে ধাবিত হয়ে অকাল মৃত্যুর মুখোমুখি হয়। পরিণামে আসে ভয়ংকর মৃত্যু।    লোভকে বর্জন করতে হবে। তবেই জীবন সকলের শ্রদ্ধা ও ভক্তি অর্জন করে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত লোভ লালসা পরিহার করা।

 

 
 
 
 
পরিশেষেঃ
 সার্ভার সমস্যার কারণে  ভিজিট করতে অনেক কষ্ট হয়ে পরে তাই সর্বাধিক চেষ্টা করছি ভালো কিছু তুলে ধরতে এবং  এই সাইট যে সকল পোস্ট করা হয় সে সকল পোস্ট কোন প্রকার প্রতারিত করার  উদ্দেশ্য নহে।এ পোস্ট গুলি আপনাদের ভালোলাগার জাইগা দখল করলে লাগলে সাইট এ visit করতে ভুলবেন না কিন্তু | আপনাদের জন্যই পোস্ট করে থাকি আপনারা যাতে সহজ ভাবে খুঁজে নিতে পারেন এ জন্যই সর্বাধিক চেষ্টা করে যাচ্ছি |যথেষ্ট ধৈর্য্য সহ আমাদের পোস্ট পড়ার জন্য ও আমাদের সাথে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অশেষ  ধন্যবাদ ।