বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে  যত মত, তত পথ  যে সহে সে রহে যদি হতে চাও ছোট হও তবে  এক মাঘে শীত যায় না

class 7 bangla 2nd paper book

 

বুদ্ধি যার বল তার : ভাবসম্প্রসারণ


জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস : ভাবসম্প্রসারণ?


অনেক কিছু ভাবার চেয়ে অল্প কিছু করাই শ্রেয় : ভাবসম্প্রসারণ

সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়

মূলভাব : জীবন হল সময়ের এক উদাসীন ধারাবাহিক নির্মম প্রবাহের উপর ছেড়ে দেয়া একটি ক্ষুদ্র ঘটনা, যার শুরু এবং শেষ উভয়ই সময়ের হাতে বন্দী এবং সময় দ্বারা শাসিত। তাই সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে।

সম্প্রসারিত ভাব : সময় অতীব মূল্যবান। জীবনের যা কিছু অবদান, যা কিছু স্থিতি, যা কিছু মূল্য, সব সময়ের হাতেই বাধা। সমাজে মানুষের অনেক কাজ আছে। তার উপর নির্ভর করে তার প্রাপ্তি, তথা জীবনের সফলতা ও শান্তি। প্রতিটি মুহূর্তকে জীবনের পর্যায় অনুসারে প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে যদি যথাযথ কাজের মাধ্যমে সার্থক করে তোলা যায় তাহলে জীবনের সার্থকতা। সময়কে আমরা ধরতে পারি না, ছুঁতেও পারি না। আমরা পারি তাকে কাজের মধ্যে ধরে রাখতে। সময়কে কাজের মধ্যে বেঁধে রাখা এবং সঠিক কাজকে সঠিক সময়ের হাতে সমর্পণ করাই সফলতার পূর্বশর্ত। সময়কে ভালোভাবে কাজে খাটানোর জন্য বর্তমান যুগে সবচেয়ে বড় কথা হল ‘যুগের’ সাথে এগিয়ে চলা, শুধু ‘সময়ের’ সাথে নয়। অর্থাৎ, যে মুহূর্তে সময়ের যা কিছু শ্রেষ্ঠ অবদান, সে মুহূর্তে তাকে অর্জন করার জন্য সর্বাধিক চেষ্টা করতে হবে। এভাবে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করা উচিত। আজকের কাজ আগামীর জন্য ফেলে না রাখা উত্তম। কেননা আজকের কাজটা যতটা সহজসাধ্য আগামীতে তেমনটি নাও হতে পারে। তা ছাড়া সময়ের কাজ সময়ে না করে ফেলে রাখলে পরে ঐ কাজ করেও কোন ফল হয় না। কারণ যে ফল অকালে পাকে, কালে তা পঁচে যায়, তেমনি যে কাজ আজকের তা আগামীর জন্য রেখে দিলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। উদাহরণ স্বরূপ চৈত্র মাসে চাষ না করে বৈশাখ/জৈষ্ঠ্য মাসে করলে হেমন্তে সে ধান আশা করতে পারে না। কেননা, চৈত্র মাসই ছিল চাষের উপযুক্ত সময়।

জীবনকে সার্থক করে তুলতে চাই সময়ানুবর্তিতা। অর্থাৎ, সঠিক কাজটি সঠিক সময়ে করার মাধ্যমে সময়ের সদ্ব্যবহার করা হয়। আজকের কাজ আগামীর জন্য ফেলে রাখা বোকামি। কেননা, আগামী দিন ঐ কাজটি করার জন্য উপযুক্ত সময় নয়।

মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন?

সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন- ‘তিনি সেই জাতির উন্নতিতে সাহায্য করেন না, যে জাতি নিজেকে সাহায্য করে নাযেকোনো ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের উন্নতির পূর্বশর্ত হলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিশ্রম করা সুপ্রাচীন কালেই মানুষ অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছিল যে, পরিশ্রমের সঙ্গে ধনের, এবং আলস্যের সঙ্গে দারিদ্রের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি তত বেশি সফল উন্নয়নের জন্য সংক্ষিপ্ত কোন পথ নেই অলস, কর্মবিমুখ ব্যক্তিরা সর্বদাই নিয়তিকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকে কোনো পরিশ্রম না করেই ফলে তারা কিছুই পায় না এবং তাদের জীবনে নেমে আসে দুঃখ-যন্ত্রণা ইতিহাসের দিকে তাকালে এর অনেক উদাহরণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের মানুষ- বৃহত্তরভাবে ভারতবর্ষের মানুষ আরাম-আয়েশ পছন্দ করে এরা অধিকাংশ শ্রমবিমুখ, আড্ডাবাজ আমুদে তাই অঞ্চলে তেমন কোন উন্নয়ন বা অগ্রগতি হয়নি সে তুলনায় ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ অনেক বেশি পরিশ্রমী, অনেক বেশি কষ্টসহিষ্ণু তাই তারা এত উন্নতি লাভ করেছে এশিয়ার জাপানিরা সবার চেয়ে এগিয়ে আছে এই কারণে যে, তারা অত্যন্ত পরিশ্রমী যেকোনো জাতির উন্নয়ন অগ্রগতির প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো নিজ নিজ কাজে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করা আত্মবিশ্বাস নিয়ে যথাযথ পরিশ্রমের মাধ্যমেই আসে কাক্সিক্ষত সফলতা

শিক্ষা: পরিশ্রম হলো উন্নতির পূর্বশর্ত। তাই উন্নতি লাভের জন্য জীবনের লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য হতে হবে কঠোর পরিশ্রমী এবং আত্মপ্রত্যয়ী

 

মা এবং মায়ের মুখের ভাষা দুটোর মূল্যই সমান?

মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা ভাষা না থাকলে সুন্দরভাবে মনের কথা অন্যের কাছে বলা সম্ভব ছিল না মা, মাতৃভাষা মাতৃভূমি প্রতিটি মানুষের কাছেই অমূল্য সম্পদ যেকোনো সন্তানের কাছে মায়ের ঋণ অপরিশোধযোগ্য সন্তানকে লালন পালন করতে গিয়ে একজন মা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন সন্তাানের মঙ্গল কামনায় নিরলস সেবা যত্ন করেন তাই সন্তানের কাছে মা সব সময়ই মঙ্গলময়ী, স্নেহময়ী, মহিমাময়ী তেমনি মাতৃভাষাও মানুষের অস্তিত্বের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ মা ছাড়া কোন শিশুর জীবন কখনও পরিপর্ণ হয় না তেমনি মাতৃভাষা ছাড়াও কোন জাতির পূর্ণ পরিচয় ফুটে উঠে না বিদেশী ভাষায় কথা বলে মনের শান্তি পাওয়া যায় না জন্যই পৃথিবীর সকল জাতি তার মাতৃভাষা চর্চা করে থাকে মায়ের অমর্যাদা বা অপমান যেমন কোন সন্তান সহ্য করতে পারে না তেমনি মাতৃভাষার অপমানও কোনো জাতি মেনে নেয় না তাই ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা দাবিতে প্রাণ দিতেও পিছপা হয়নি এদেশের সাহসী সন্তানেরা আর এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০০০ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিদেশী ভাষা কখনও কারো মন প্রাণের মুক্তি দিতে পারে না মানুষ কথা বলে মায়ের ভাষায়, স্বপ্ন দেখে মায়ের ভাষায়; তাই মাতৃভাষা অদ্বিতীয় মায়ের কাছে যেমন সন্তান তৃপ্তি পায়, তেমনি মাতৃভাষাও যে কোন জাতির জাতীয় পর্যায়ে পরিতৃপ্তির অন্যতম উৎস

শিক্ষা: প্রত্যেক জাতি যেমন মায়ের কাছে ঋণী। তেমনি মাতৃভাষার কাছেও ঋনী। মা জন্মদান করে আর মাতৃভাষা বিশ্ব দরবারে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে। সকল জাতি এবং সভ্যতা মা এবং মায়ের ভাষার প্রতি কৃতজ্ঞ শ্রদ্ধাশীল থাকা আবশ্যক

 

 মাটি হতে হে মানব তোমার জনম, আগুনের মতো কেন হও হে গরম

মানুষ মরণশীল কোনো এক অজ্ঞাত জগত থেকে মানুষের š§, আবার সেই অচেনার দিকেই মানুষের যাত্রা মাটি থেকে ¯্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, মৃত্যুর পর দেহ আবার মাটিতেই মিশে যাবে মাঝখানে কিছু দিন মানুষ এই রঙিন পৃথিবীর মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলে ক্ষণিকের পৃথিবীর প্রতি মানুষের আজš§ টান নিজের অপ্রতিরোধ্য পরিণাম ভুলে মানুষ এই পৃথিবীতে টিকে থাকার লড়াইয়ে সর্বদা লিপ্ত, সকলেই ব্যস্ত তার অফুরন্ত ক্ষুধা মিটাতে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মানুষ সারাক্ষণ চিন্তা করে তার চাহিদার কোনো শেষ হয় না প্রতিনিয়ত ছুটতে থাকে নিজের স্বপ্ন পূরণের নেশায় যখন কেউ উন্নতির শীর্ষে পৌঁছে যায় তখন ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদার মোহে সে হয়ে যায় অন্ধ আত্ম অহংকারের বিষে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে থাকে এই অহংকারের জালে পড়ে মানুষ হারিয়ে ফেলে তার মনুষ্যত্ব তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত নিচু শ্রেণির মানুষের প্রতি ঘৃণা দেখায় মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে না কিন্তু বিধাতা এতটা সহ্য করেন না অহংকারীর পতন অনিবার্য নিয়তির অনিবার্য নির্দেশে এক সময় তাকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমাতে হয় নিরুদ্দেশের পথে মাটির শরীর আবার মাটিতেই মিলিয়ে যায় তাই এই নশ্বর জীবন নিয়ে মানুষের অহংকার করা উচিত নয় নশ্বর জীবন তখনই সার্থক হয়ে ওঠে যখন তা মানবতার সেবায় ব্যয় করা হয় অহংকারী মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে তার নাম হারিয়ে যায় মহাকালের স্রোতে কিন্তু যারা মানব কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ তারা মৃত্যুঞ্জয়ী তাদের ক্ষুদ্র দেহটি মাটিতে মিলিয়ে গেলেও তারা অক্ষয় হয়ে থাকে মানুষের মনের মন্দিরে

শিক্ষা: মানুষের জীবন অতি সীমিত অনিশ্চিত। অনিশ্চিত জীবন নিয়ে অহংকার করা উচিত নয়। ক্ষুদ্র জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে প্রয়োজন মানবতার সেবায় জীবন উৎসর্গ করা

 

 

মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়

মানুষের জীবনকে বয়সের সীমারেখা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না দীর্ঘজীবন মানুষের বড়ত্বকে প্রকাশ করে না মৃত্যু মানুষের জীবন যাত্রাকে থামিয়ে দেয় কিন্তু কর্মের ফল এবং গুণাগুণ বিদ্যমান থাকবে পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবন থেমে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে কিন্তু নিজ কর্মের মাধ্যমে মানুষ বেঁচে থাকে অনন্তকাল কর্মের দ্বারাই মানব মনে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয়া যায় মানুষ যেকোনো ব্যক্তিকে তার কর্মফল বা কর্মগুণ দ্বারা বিখ্যাত বা কুখ্যাত হিসাবে মূল্যায়ন করে দীর্ঘকাল যাবত মহৎ কর্মই মানুষকে অমরত্ব দান করে মহৎ সৃষ্টিশীলতার জন্যই মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে বিবেচিত হয়েছে ভাল কাজই মানুষকে এক যুগ থেকে অন্য যুগে পৌঁছে দেয় মানুষকে শ্রদ্ধা, ভক্তি ভালোবাসায় সিক্ত করে পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ এসেছে, অনেকে চলে গেছে, কিন্তু মহাকালের যাত্রায় স্থান করে নিয়েছে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ তাঁদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁদের মহৎকর্ম মানবজীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো তার মহৎকর্ম মৃত্যুর পরও মানুষ তার মহৎ কর্মগুণে অমরত্ব লাভ করে মহামানবদের দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও তাদের মহৎ কর্ম আজও শাশ্বত অম্লান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাদার তেরেসা, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, নিউটন প্রমুখ তাঁদের কর্মের মাধ্যমে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন মৃত্যুর পরেও তাঁরা মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় বেঁচে আছেন তাঁদের কর্মই তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁদের কল্যাণধর্মী চিন্তা কর্ম মানুষকে যতদিন প্রাণিত করবে, পথ দেখাবে তাঁরা ততদিন বেঁচে থাকবেন

শিক্ষা: কর্মই মানুষের প্রকৃত পরিচয়। মহৎ কাজের মাধ্যমেই মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে। ফলে জগতের কল্যাণকর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা উচিত

 মানুষকে ভুল করিতে না দিলে মানুষকে শিক্ষা লাভ করিতে দেওয়া হয় না

শিক্ষা মানবজীবনকে সামনে এগিয়ে নেয়, এনে দেয় পরিপূর্ণতা শিক্ষা লাভের জন্য মানুষ বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করে সব কাজই নির্ভুল হয় না কারণ মানুষের অভিজ্ঞতা লাভের পথে ভুল ভ্রান্তি হওয়াটা স্বাভাবিক নির্ভুলভাবে কাজ করতে হবে এই শর্ত কাজের বেলায় আরোপ করা ঠিক নয় কারণ ভুল করাই মানুষের স্বভাব তাই কারো পক্ষেই কাজের নির্ভুলতার অঙ্গীকার করা সম্ভব নয় নেপোলিয়ান বলেন- “যদিও আমি ইউরোপের একজন বিশিষ্ট সৈনিক তবু আমি দিনে দশটি ভুল করিকাজের ভুল ভ্রান্তি থেকেও মানুষ নতুন করে শিক্ষা লাভ করে কেননা পৃথিবীর যত বড় বড় আবিষ্কার সবই সম্ভব হয়েছে ভুল থেকে অর্জন করা নতুন শিক্ষা লাভের ফল হিসেবে বার বার ভুল করেও তারা থেমে যাননি বরং ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন প্রত্যয়ে কাজ শুরু করেছেন ফলস্বরূপ পেয়েছেন সত্যের দেখা আর সফলতা শেখ সাদী বলেন- “যার জীবনে যত ভুল তার জীবনে তত মঙ্গল অন্ধকারের অলিগলি পার হয়েই তো আমরা আলোর সন্ধান পাইতাই কাজে কোনো ভুল হলে তা অপরাধ হিসেবে নেওয়া ঠিক নয় শিক্ষা লাভের জন্য কেউ ভুল করলে তাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে তাকে ভুল সংশোধনের জন্য সুযোগ দিতে হবে ভুল অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে সংশোধন করলেই সে সফলতা অর্জন করতে পারবে ভুল সংশোধন না করে ভুলকে অন্যায়ের দৃষ্টিতে বিচার করলে শিক্ষা লাভের পথযাত্রা থেমে যাবে তাই ভুলকে বিবেচনায় রেখেই শিক্ষা লাভ করতে হবে তবেই শিক্ষা অর্থবহ হয়ে উঠবে

শিক্ষা: ভুল থেকেই সাহসের জন্ম হয়। কেননা ভুল সংশোধন করার সর্বাত্মক চেষ্টার মাধ্যমেই শিক্ষা লাভের পথ সুগম হয়

 

 

মানুষের সর্বাপেক্ষা ভারী বোঝা হচ্ছে ক্রোধ?

তীব্র অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশকে ক্রোধ বলে। ক্রোধ মনুষ্য চরিত্রের এক অস্বাভাবিক অবস্থা যা সুনির্দিষ্ট কারণে হয়ে থাকে। মানবচরিত্রের একটি খারাপ দিক ক্রোধ। কারো ক্রোধ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্রোধের কারণে মনের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে। তখন মানুষ খুন খারাবি পর্যন্ত করে বসতে পারে। তাই ক্রোধ নিবারণ অপরিহাযর্, নচেৎ জীবনের সমূহ বিপর্যয় অনিবার্য। ক্রোধ বা রাগ জীবনের একটি বড় অনুষঙ্গ। কেউ অল্পতে রেগে যায়, কেউ সহজে রাগই করে না। মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা অবদমিত ক্রোধ আমাদের ভালো থাকার পেছনের শত্রু। এটি মানুষের সঙ্গে মানুষের সৌহার্দ্য সুসম্পর্ক নষ্ট করে। ক্রোধ আসলে একটি সাধারণ সুস্থ আবেগ। তবে অনিয়মিত অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ ক্ষতিকারক যা প্রায়ই দৈনন্দিন সাংসারিক সম্পর্ক জীবনের স্বাভাবিক গুণগতমান নষ্টসহ বিভিন্ন ধরণের সমস্যা সৃষ্টি করে। ক্রোধ এমন ধরণের আবেগ যা বিরক্তিবোধ থেকে গভীর আক্রোশ উম্নোক্ত উত্তেজনা পর্যন্ত বিস্তৃত। কিছু লোক সত্যিকার অর্থে ক্ষেপাটে প্রকৃতির। তারা সহজেই সামান্য কারণে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ে। হতাশা, বিড়াম্বনা বিরক্তি সহজেই তাদের বিচলিত করে; কোনো কিছুই তারা সহজভাবে নিতে পারে না। তখন ক্রোধ হয়ে ওঠে তার জীবনের বোঝা স্বরূপ। এই ক্রোধ মানুষের স্বভাবজাত। স্বভাব থেকে তা দূর করা সম্ভব নয়। কিন্তু নিজে ক্রোধের বশবর্তী না হয়ে ক্রোধকে নিজের বশে আনতে পারলেই তার কুফল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই মনীষীরা বলেন- ‘প্রকৃত বীরপুরুষ ব্যক্তি নয়, যে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করে ফেলে বরং প্রকৃত বীরপুরুষ ব্যক্তি যে ক্রোধের মুহূর্তে নিজেকে সংযত রাখতে পারে।

শিক্ষা: ক্রোধের মুহূর্তে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং অনেক সময় এমন কাজ করে যা তার জন্য বিশেষ গ্লানি বয়ে আনে। তাই ক্রোধের মুহূর্তে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করতে হয়

 

 যত মত, তত পথ

একই স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষ কিন্তু সেই মানুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায় একই সময়ে জন্ম নেয়া দুটি জমজ শিশুর মধ্যেও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বিদ্যমান পার্থক্য দেখা যায়, তাদের পছন্দ-অপছন্দের, মতামতের ধর্ম, পরিবেশ, সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি মানুষে মানুষে পার্থক্য সৃষ্টি করে এক ধর্মের অনুসারীদের রীতিনীতি, জীবনাচার ইত্যাদি অন্য ধর্মের অনুসারীদের চেয়ে ভিন্ন হয় কারণ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে আবার উচ্চবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যেও দৃষ্টিভঙ্গি এবং মতামতের সুবিশাল পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে জন্ম নেয়া একটি শিশু যেভাবে গড়ে উঠে, নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে জন্ম নেয়া শিশু সেভাবে গড়ে উঠে না উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে শিশুটি যেমন সুযোগ-সুবিধা পায়, নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে জন্ম নেয়া শিশুটি তেমন সুযোগ-সুবিধা পায় না তাই তাদের জীবনধারার মধ্যে বিস্তর অমিল দেখা যায় সব মানুষ যখন তাদের নিজ নিজ বিশ্বাস এবং জীবনধারা সুষ্ঠুভাবে মেনে চলে তখন সমাজে শান্তির সুবাতাস বয়ে চলে সমাজে তখন কোনো অশান্তি দেখা যায় না কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটলেই সমাজে নেমে আসে অশান্তি এক ধর্ম বর্ণের মানুষের সাথে অন্য ধর্ম বর্ণের মানুষের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব রেষারেষি, যা সমাজের সুন্দর পরিবেশকে এক মুহূর্তেই নষ্ট করে দেয় একজনের নিজস্ব মতামত যখন অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, তখনই সমাজে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় ফলে নষ্ট হয় সম্প্রীতির বন্ধন মানুষের নিজের মতকে অপরের ওপর চাপিয়ে দেয়ার হীন মনোবৃত্তি তাকে করে তোলে অহংকারী এবং উগ্র পৃথিবীতে সমস্যা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে সমস্যার সমাধান মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি যতো ভিন্নই হোক না কেন প্রত্যেকেই নিজস্ব পথ অবলম্বন করে লক্ষ্যে পৌছায় তাই বলা যায় পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে সমাধানের পথও ভিন্নতর হয়

শিক্ষা: পৃথিবীতে প্রতিটি সমস্যার রয়েছে সমাধান। দৃষ্টিভঙ্গি যতো ভিন্ন হবে তার প্রয়োগ পদ্ধতিও ততো ভিন্নতর হবে। তাই সমাজের শান্তি এবং সম্প্রীতি রক্ষার জন্য সকলের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া, সমাজের প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব কর্তব্য

 

যতক্ষন শ্বাস, ততক্ষন আঁশ

মানুষের চলার পথ মসৃণ নয় প্রতিটি পদক্ষেপ নানা বাধা-বিপত্তিতে ভরা চাওয়ার সাথে পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করতে হয় তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে আশায় বুক বাঁধে অসংখ্য তরঙ্গ যেমন সাগরকে বিক্ষুদ্ধ করে, তেমনি দুঃখ-কষ্ট সংসার জীবনে মানুষকে করে তোলে হতাশ বিপর্যস্ত ভেলা ভাসিয়ে মানুষ যেমন উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দেয় তেমনি আশার তরীতে ভেসে মানুষ সংসারের সাগরকে অতিক্রম করে উত্তাল সাগরে মানুষের অবলম্বন হয় ভেলা আর সংসারে মানুষের অবলম্বন হয় আশা বা স্বপ্ন সমস্যা এবং দুঃখ স্থায়ী নয় আজকের দিনের সমস্যা এবং দুঃখ একদিন না একদিন শেষ হবে অন্ধকার কালো রাতের পর নতুন ভোর আসবে দুঃখের দিনের একদিন অবসান ঘটবে, এই আশাতেই মানুষ সকল দুঃখ কষ্টকে অতিক্রম করে আশা না থাকলে কোনো মানুষ বাচঁতে পারতো না এক মুহুর্তের জন্যেও যেদিন মানুষ স্বপ্ন দেখা ভুলে যাবে, সেদিনই তার কাছে বেঁচে থাকা মূলহীন হয়ে পড়বে এই জগতের কোনো কিছুই আর তাকে আকর্ষণ করবে না আশা বা স্বপ্ন মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় সাফল্যের পথে প্রেরণা যোগায় প্রতিটি ক্ষণে ভবিষ্যতের আশা বা স্বপ্ন প্রেরণা যোগায় বলেই, বর্তমানকে আমরা মেনে নিতে পারি

শিক্ষা: আশা বা স্বপ্ন আছে বলেই, নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পৃথিবী আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন ভোর আসবে এই বিশ্বাস আছে বলেই, মানুষ অত্যন্ত সহজভাবে জীবনকে গ্রহণ করেছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে একেকটি নতুন স্বপ্নের দিকে

 

রাখি যাহা তাহা বোঝা, কাঁধে চেপে রহে দিই যাহা তার ভার বরাবর বহে

আদিম যুগের মানুষ শুধু নির্ভরশীল ছিল খাদ্য সংগ্রহ আর ভোগ করার উপর সঞ্চয় না থাকাতে তাদের পোহাতে হত নিদারুন কষ্ট মানুষ যখনই সঞ্চয় করতে শিখেছে সভ্যতার যাত্রা শুরু তখনই খাদ্য এবং সম্পদের সংরক্ষণ মানুষকে আধুনিক সভ্যতার পথ দেখিয়েছে সঞ্চয়ের উপর ভিত্তি করে মানুষ গড়ে তুলেছে সুরম্য প্রাসাদ, অতিকায় অট্টালিকা সমাজের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাই মানুষের মাঝে বৈষম্য কেউ মনোরম প্রাসাদে বিলাসী জীবন যাপন করছে, আর কেউ পথের পাশে পড়ে আছে অনাহারে মানুষ যখনই সঞ্চয়ের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে বৈষম্যের সূচনা হয়েছে তখনই সঞ্চয়ের মানসিকতা মানুষকে ভোগবাদী হতে শিখিয়েছে আর ভোগবাদী মানসিকতাই সমাজে বৈষম্যের সূত্রপাত করে স্রষ্টার সৃষ্টি হিসেবে আমরা শ্রেষ্ঠত্ব পেয়েছি কিন্তু এর নির্দশন আমরা রাখতে সক্ষম হইনি মানবতাবোধ না থাকলে মানুষ যেমন পরম আত্মার সন্ধান পায় না তেমনি অন্যের উপকার না করলে জীবাত্মা সন্তুষ্ট হয় না আমরা যা কিছু সঞ্চয় করি তা সম্পূর্ণ নিজের জন্য কিন্তু সঞ্চয়ের অংশ বিশেষ যদি আমরা সমাজ, রাষ্ট্রের কাজে ব্যয় করি, তবে তার ফল পুরো বিশ্ব ভোগ করে সম্পদ একা ভোগ করে যেমন আনন্দ নেই তেমনি তাতে অন্যের উপকারও হয় না মানব কল্যাণে, মানবতার উপকারে ব্যয় করা সম্পদ সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে আসে প্রকৃত মহৎ মানুষ তার সম্পদ মানব কল্যাণেই ব্যয় করে এর ফলে মানজবজাতি যেমন উপকৃত হয় তেমনি স্রষ্টার সন্তুষ্টিও অর্জিত হয়

শিক্ষা: সম্পদ বা সঞ্চিত ধন যদি কেউ অন্যের উপকারে ব্যয় করে, তখন তার সুফল দ্বারা সমগ্র দেশ, জাতি সর্বোপরি সারাবিশ্ব উপকৃত হয়। মানুষের এই জনকল্যাণকর কাজ প্রকৃতিকে করে তোলে সমৃদ্ধ। মানবতা হয়ে উঠে সুশোভিত

 

 

 রৌদ্রে পুড়ে বৃষ্টিতে সে ভিজে দিবা-রাতি মোদের ক্ষুধার জন্য যোগায়, চায় নাকো সে খ্যাতি?

চাষীরা দেশের সেবক রোদে পুড়ে ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে তারা ফসল উৎপাদন করে সে ফসলে আমাদের অন্ন যোগায় সারা দেশের খাদ্যাভাব দূর করে কৃষকেরা যদি অকাতরে তারা বিলিয়ে না দিতো, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল না ফলাত তা হলে আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজের দেহের রক্তকে পানি করে জাতীয় অর্থনীতিকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে কৃষকের উৎপাদিত কাঁচামাল বিদেশে রফতানি করে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয় বৈদেশিক মুদ্রায়, সম্ভব হয় শিল্পায়ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামজীবন-বন্দনাকবিতায় তাই কৃষকদের সম্পর্কে বলেছেন- ‘গাহি তাহাদের গান, ধরণীর হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমানরাজিয়া খাতুন চৌধুরাণীচাষীকবিতায় বলেছেন- ‘মুক্তিকামী মহা সাধক মুক্ত করে দেশ, সবারই সে অন্ন যোগায় নাইকো গর্ব লেশএই উক্তিটি থেকেই স্পষ্টতই কৃষকদের সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় কঠোর সাধকের মতো কৃষকও কঠিন পরিশ্রম করে সবার জন্য ফসল ফলায় অর্থাৎ ফসল ফলিয়ে সকলের অন্নসংস্থান করাটা তার সাধনা কিন্তু সমগ্র মানবজাতির জন্য এত বড়ো উপকার সাধন করেও তার বিন্দুমাত্র অহংকার নেই তারা জাতির কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখে কোনো স্বার্থ গর্ব ছাড়াই

শিক্ষা: কৃষকেরা রোদ বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে দিনরাত পরিশ্রম করে কঠিন মাটির বুকে লাঙ্গল চালিয়ে ফসল উৎপাদন করে। তাদের উৎপাদিত ফসলে ধনী গরীব সকলের অন্ন সংস্থান হয়। তাদের মধ্যে নেই কোনো হিংসা, বিদ্বেষ কিংবা গর্ব। তাদের এসব গুণ মহানুভবতা দেখে আমাদের সকলের উচিত তাদের প্রতি সম্মান দেখানো

  

 স্বর্ণ করে নিজ রূপে অপরে শোভিত বংশী করে নিজ স্বরে অপরে মোহিত - ভাবসম্প্রসারণ

স্বর্ণ তার নিজের সৌন্দর্য দিয়ে অন্যকে সাজায় পরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সে নিজেকে নিবেদন করে অপরদিকে বাঁশিও কখনো নিজের জন্য সুমধুর, সুরেলা ধ্বনি সৃষ্টি করে না বরং তার সেই সুর সৃষ্টি হয় শুধুমাত্র অন্যদেরকে মুগ্ধ করার জন্য, আনন্দ দেয়ার জন্য, বিমোহিত করার জন্য এই স্বর্ণ বাঁশির সৃষ্টি যেন শুধুমাত্র অপরের মনোরঞ্জনের জন্য হয়েছে এখানেই তাদের সৃষ্টির সার্থকতা স্বর্ণ বাঁশির মতো মানব জীবনেরও ধর্ম হলো পরের জন্য কাজ করা, অন্যের মঙ্গলসাধন করা, পরের কল্যাণে নিজের জীবনকে সর্বদাই নিয়োজিত রাখা ফুল যেমন নিজের জন্য ফোঁটে না তেমনি মানুষের জীবনও শুধু তার নিজের জন্য নয় অপরকে ভালোবাসার মধ্যে যে তুষ্টি, পরের জন্য কিছু করার মধ্যে যে প্রশাšিতা আর কোনো কিছুতেই নেই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব এই কারণে যে, তার বিচার, বুদ্ধি, বিবেক আছে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে অন্যকে ভালোবেসে তার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে আর এই উৎসর্গ করতে পারার মধ্যেই মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত পরোপকারীতার মধ্যেই নিহিত প্রকৃত মহত্ত্ব অপরের কল্যাণ সাধনের নিমিত্বেই কাজ করেন জগতের সকল মহান ব্যক্তিবর্গ নিজেদের জীবন কর্মকে উৎসর্গ করেন সমগ্র মানবজাতির উৎকর্ষ সাধনে

শিক্ষা: নিজের জন্য নয়, পরের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করাই মানব জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত

 

 মৃত্যুই কেবল উৎকোচ গ্রহণ করে না?

লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব বিরাজমান। প্রবাহমান সময়ের সাথে প্রতিটি প্রাণকেই একদিন মৃত্যুর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হতে হয়। মহাকালের স্রোতে ভেসে একদিন আমাদেরকেও একদিন বিদায়  নিতে হবে পৃথিবী থেকে। কারণ মৃত্যুই একমাত্র সত্য যা বিশ্বাস না করলেও মেনে নিতে হবে। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ তার স্বার্থ হাসিলের জন্য নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে আসছে। সেই সূত্র ধরেই সমাজে উৎকোচ বা ঘুষ প্রথার প্রচলন। বর্তমান সময়ের এক মারাতœক ব্যাধির নাম উৎকোচ, যা সমাজের ক্ষয়িষ্ণুতার এক অনন্য প্রতীক। উৎকেচের সাহায্যে আজকাল বহু অসাধ্য সাধন হয়ে যাচ্ছে। নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে  মানুষ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য মরিয়া। কিন্তু উৎকোচ গ্রহণ করে না বা উৎকোচ দিয়েও কার্যসিদ্ধি করা না এমন অনেক কিছু আছে। মৃত্যু এমন এক অনিবার্য ঘটনা যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় নেই। মৃত্যুকে তাই উৎকোচ দিয়েও নিবারণ করা সম্ভব নয়। কারণ মৃত্যু উৎকোচ গ্রহণ করে না। তাই উৎকেচের মাধ্যমে নয় বরং সততা ও সাহসিকতা দিয়েই অনিবার্য সত্যকে আলিঙ্গন করতে হয়, তবেই আসে মানবজীবনের পূর্ণতা।

শিক্ষা: সত্যকে সাহসের সাথে গ্রহণ করাই শ্রেষ্ঠ পথ।

 মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন : ভাবসম্প্রসারণ

সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন- ‘তিনি সেই জাতির উন্নতিতে সাহায্য করেন না, যে জাতি নিজেকে সাহায্য করে না।’ যেকোনো ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের উন্নতির পূর্বশর্ত হলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিশ্রম করা। সুপ্রাচীন কালেই মানুষ অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছিল যে, পরিশ্রমের সঙ্গে ধনের, এবং আলস্যের সঙ্গে দারিদ্রের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি তত বেশি সফল। উন্নয়নের জন্য সংক্ষিপ্ত কোন পথ নেই। অলস, কর্মবিমুখ ব্যক্তিরা সর্বদাই নিয়তিকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকে কোনো পরিশ্রম না করেই। ফলে তারা কিছুই পায় না এবং তাদের জীবনে নেমে আসে দুঃখ-যন্ত্রণা। ইতিহাসের দিকে তাকালে এর অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মানুষ- বৃহত্তরভাবে ভারতবর্ষের মানুষ আরাম-আয়েশ পছন্দ করে। এরা অধিকাংশ শ্রমবিমুখ, আড্ডাবাজ ও আমুদে। তাই এ অঞ্চলে তেমন কোন উন্নয়ন বা অগ্রগতি হয়নি। সে তুলনায় ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ অনেক বেশি পরিশ্রমী, অনেক বেশি কষ্টসহিষ্ণু। তাই তারা এত উন্নতি লাভ করেছে। এশিয়ার জাপানিরা সবার চেয়ে এগিয়ে আছে এই কারণে যে, তারা অত্যন্ত পরিশ্রমী। যেকোনো জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো নিজ নিজ কাজে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করা। আত্মবিশ্বাস নিয়ে যথাযথ পরিশ্রমের মাধ্যমেই আসে কাক্সিক্ষত সফলতা।

শিক্ষা: পরিশ্রম হলো উন্নতির পূর্বশর্ত। তাই উন্নতি লাভের জন্য জীবনের লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য হতে হবে কঠোর পরিশ্রমী এবং আত্মপ্রত্যয়ী।

 

মনের আজ কহ যে ভাল-মন্দ যাহাই আসুক সত্যরে লও সহজে : ভাবসম্প্রসারণ

মানবজীবন বিচিত্র বর্ণিল। এই জীবন বিকাশে সুখ-দুঃখ, বিরহ-বেদনা, উত্থান-পতনের মতো প্রতিকূল পরিবেশের প্রাচীর ডিঙিয়ে মানুষকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। মানবজীবনে চলার পথে বাধা-বিঘœ থাকবেই। মানুষকে ধৈর্যধারণ করে কঠিন সত্য ও প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হয়। এজন্য বিপদশঙ্কুল পথ অতিক্রমে, জীবনের কঠিন দুঃসময়ে টিকে থাকতে সর্বাগ্রে দরকার মনোবল। সত্যকে আয়ত্ব করা ও মেনে নেওয়া যদিও খুব সহজ নয়, তবুও পৃথিবীতে সাহস, মনোবল ও মনুষ্যত্বের প্রকৃত পরিচয় মেলে সত্যকে সহজে গ্রহণ ও প্রকাশ করার মধ্যেই। সত্যের ভয়ে ভীত হওয়া দুর্বল চিত্তের নিত্য চিত্র। কিন্তু মানুষের জীবনে দুঃসময় চিরস্থায়ী নয়। অন্ধকারের পরে যেমন আলো আসে, দুঃসময়ের পরে তেমনি মানবজীবনে সুখ ও সুদিন আসে। মানুষ দুঃখ, মন্দ আর বিপদকে ভয় করে। সামান্য বিপদেই সে বিচলিত হয়ে পড়ে। বাস্তব জীবনে বিপদ ও দুঃখের প্রয়োজন আছে। দুঃখের অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষের চিত্ত ও মন শুচিশুভ্র হয়। আত্মজিজ্ঞাসায় সত্যের সন্ধান মিললে তবেই জগতে নিজেকে জানতে পারা যায়। আর সত্যের কারণে সামনে আসতে পারে বঞ্চনা, সবশেষে মৃত্যু। মিথ্যার বিস্তারে সত্য সাময়িক ক্ষীণ হলেও কালক্রমে সত্যের ঔজ্জল্য প্রস্ফূটিত হয়। অর্থঃ াৎ বাস্তবতা ও সত্য যত কঠিনই হোক, সেটিকে ভালোবেসে মনের শক্তি দিয়ে অতিক্রম করতে পারলেই জীবনে সাফল্য লাভ করা সম্ভব। জীবনে চরম দুঃখ-কষ্টের মাঝেও কঠিন বাস্তবকে সহজ সত্য হিসেবে গ্রহণ করে সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করাই মানব জীবনের পরম সার্থকতা।

শিক্ষা: জীবনের চরম ক্রান্তিকালে দুঃখ, বিপদ, বেদনায় ভীত না হয়ে যুক্তি দিয়ে বিচার করে সহজে সত্যকে মেনে নিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।

 

বেঁচেও মরে যদি মানুষ দোষে মরেও বাঁচে যদি মানুষ ঘোষে : ভাবসম্প্রসারণ

মানুষ মরণশীল। এ জগতে জন্মিলে অবশ্যম্ভাবীভাবে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু মহৎব্যক্তিরা মরেও বেঁচে থাকে। মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত। এ সংক্ষিপ্ত জীবনে মানুষ যদি কল্যাণমূলক কাজ না করে, নিজেকে সত্যের পথে পরিচালিত না করে তবে সে বেঁচেও মরে থাকে। তার জীবন ব্যর্থ, বিফল। এ বিফল জীবনের মানুষটিকে কেউ মনে রাখে না। কেউ তাকে গুরুত্ব দেয় না। তার মৃত্যুর সাথে সাথে সে মাটির সাথে নিঃশেষ হয়ে যায়। পৃথিবীর মানুষ তাকে মনে রাখার মতো সে কিছুই করতে পারেনি। অথচ যে মানুষ নিজেকে মহৎ কাজে নিযুক্ত করে, অপরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে তাকে পৃথিবীর মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। সে মৃত্যুবরণ করলে তার শুধুমাত্র দৈহিক ধ্বংস সাধন হয়, কিন্তু মৃত্যুর পর সে তার মহৎকর্মের মধ্যে বেঁচে থাকে। এখানেই মানুষের জীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। কর্মের সাফল্য তাকে মৃত্যুর পর শত শত বছর বাঁচিয়ে রাখে। জন্ম ও মৃত্যুর সময়সীমার মধ্যে মানুষ যদি গৌরবময় ও মানবকল্যাণমূলক কাজ করে তবে সে মরেও অমর থাকে। তার দেহের মৃত্যু হলেও তার কীর্তি মৃত্যুহীন। তিনি তার কর্মের মধ্যেই অমর হয়ে থাকেন।

শিক্ষা: মানুষের নশ্বর দেহের বিনাশ আছে। কিন্তু মানুষের সুকীর্তির বিনাশ নেই। একমাত্র মহৎ কর্মই মানুষকে অমর করে রাখে। প্রত্যেক মানুষেরই উচিত নিজ কর্মের প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ করা।

 

 বিদ্বানের দোয়াতের কালি শহিদের রক্তের চেয়েও পবিত্র : ভাবসম্প্রসারণ

বিদ্যা অমূল্য সম্পদ। আর বিদ্বান ব্যক্তি মানবতার মুক্তির পথপ্রদর্শক। বিদ্বান ব্যক্তির দেখানো পথেই সমাজ ও রাষ্ট্র উন্নতির পথে এগিয়ে চলে। অন্যদিকে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় যাঁরা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেন তাঁরা শহিদ। সকল ধর্মে এবং সমাজে শহিদ ব্যক্তি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। ইসলাম ধর্মে শহিদদের মর্যাদার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (স.) শহিদের রক্তের চেয়েও বিদ্বানের কলমের কালিকে পবিত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিদ্বান ব্যক্তিকে গভীর সমুদ্রে ভাসমান জাহাজের নাবিকের সাথে তুলনা করা যায়। নাবিক যেমন জাহাজকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে, তেমনি সমাজের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যকে লাঘব করতে পারেন একজন বিদ্বান ব্যক্তি। তিনি তাঁর জ্ঞানের আলোয় সমাজের অন্ধকার দূর করতে পারেন। বিদ্যাই মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিতের বোধ তৈরি করে। সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, জন কীটস, শেকস্পিয়র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, গ্যাব্রিয়েল গর্সিয়া মার্কেজ, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ মহান ব্যক্তি সময়ে সময়ে কালে কালে এসে মানবতার মুক্তির গান গেয়েছেন। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যেমন নারী জাগরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তেমনি ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, মাদার তেরেসাও মানবতার মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। বিদ্বান ব্যক্তিরা শুধুমাত্র তাদের লেখনীর মাধ্যমে নয় বরং কর্ম দ্বারা নিজেদের ভূমিকার অপরিহার্যতা প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন। বিদ্বান ব্যক্তি গোটা সমাজটাকেই পরিবর্তন করে দিতে পারেন, পারেন নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বারকে উন্মুক্ত করতে। অন্যদিকে একজন শহিদ ব্যক্তি কেবল সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। এ কারণে বিদ্বান ব্যক্তির গুরুত্ব শহিদের চেয়ে বেশি।

শিক্ষা: মানবতার মুক্তির অগ্রপথিক বিদ্বানের ভূমিকা শহিদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের সকলকেই প্রকৃত বিদ্বান হতে হবে।

 

 বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখন বসে বিবি তালাকের ফতওয়া খুঁজেছি, ফিকাহ হাদিস চষে : ভাবসম্প্রসারণ

বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে মানবসমাজের নানা অন্ধসংস্কার। অগ্রগতির এই ধারাকে অব্যাহত ও বেগবান রাখতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও রয়েছে সমান প্রচেষ্টা ও অবদান। এই পৃথিবীতে নারী ও পুরুষ একে অপরের পরিপূরক সত্তা। তা সত্ত্বেও আমাদের সমাজ থেকে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি মুছে যায়নি। ধর্মীয় গোঁড়ামি এখনো আঁকড়ে রেখেছে সমাজকে। ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের বন্দি করে রাখা হচ্ছে। সমাজে এখনো নারীদের মনে করা হয় পুরুষদের ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার। ধর্মীয় পুরুষতান্ত্রিকতার কাছে জিম্মি হয়ে আছে নারীজাতির স্বাধীনতা। ইচ্ছেমত বিয়ে করা আর তালাক দেওয়া এখনো পুরুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করার চেষ্টা করে ধর্মীয় নীতির অপব্যাখ্যা। প্রত্যেক ধর্মে নারীদের মর্যাদার কথা বলা হলেও তারা নিজেদের মতো ব্যাখ্যার মাধ্যমে স্বীয় স্ত্রীর কর্তৃত্ব রাখছে নিজেদের হাতে। পৃথিবী যখন সভ্যতার শিখরে আরোহণ করতে যাচ্ছে তখন কিছু ধর্মীয় গোঁড়ামি আঁকড়ে ধরে হরণ করে চলেছে নারীর অধিকার। নারীর ক্ষমতায়নের যুগেও তারা স্ত্রী তালাকের ফতওয়া খুঁজে বের করার অদ্ভুত চেষ্টায় রত। এহেন গোঁড়ামি পরিহার করে তারা এখনো সামাজিক উন্নতি সাধনের স্বপ্ন সারথীদের সঙ্গী হতে পারছে না। বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে অগ্রগতি ও বৈষম্যহীনতার দিকে তখন তারা ব্যস্ত তাদের স্ত্রীদের সেবা গ্রহণ করতে। একদিকে বিশ্বের উন্নতি অবিরাম থাকলেও অন্যদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে সমাজে নারীর অবস্থানের উন্নতি হচ্ছে না। সভ্যতার ধারা তার আপন গতিতে সামনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু নারীরা এখনো আবদ্ধ রয়েছে ধর্মীয় গোঁড়ামির শৃঙ্খলে।

শিক্ষা: নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সাধিত হচ্ছে মানব বিশ্বের অগ্রগতি। ধর্মীয় গোঁড়ামি এই পথ চলাকে বাধাগ্রস্ত করে ফলে সামগ্রিক উন্নতি ব্যাহত হয়।

 

বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র নানাভাবে নানান জিনিস শিখছি দিবারাত্র : ভাবসম্প্রসারণ

শিক্ষা মানুষের অমূল্য ধন। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের চিন্তা-চেতনার পরিস্ফুটন ঘটে। শিক্ষায় মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে গড়ে ওঠে। শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতেই মানুষের শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করে না। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ জীবনের নানা ক্ষেত্রে নানা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে। মানুষ তার জন্মের পর থেকে নানাভাবে শিক্ষা লাভ করে। এই শিক্ষা তার সমাজের কাছ থেকে হয়, পরিবারের কাছ থেকে হয় আবার গুরুজন বা বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমেও হতে পারে। আবার প্রকৃতির কাছ থেকেও মানুষ শিখতে পারে। প্রতিনিয়ত তার শেখার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। ইচ্ছা এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে শেখে। জন্মের পর একটি শিশু কীভাবে কথা বলতে হবে তাকে তা শেখাতে হয় না। সে নিজে নিজে তার পরিবারের সবাইকে দেখে শিখে নেয় নিজের অজান্তেই। তেমনিভাবে সামাজিক রীতি-নীতিগুলোও সে শিখে নেয় আপনা থেকেই। নিজের জীবনকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে সমাজের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা চলে- ‘শিক্ষা হলো তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না, বিশ্বসত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।’ বাস্তবিকই মানুষ জীবন থেকে নানামুখী শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনকে বিশ্বজগতের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। মানুষ শিশুকাল থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ধাপে নতুন নতুন শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে উপযুক্ত মানুষ হিসেবে প্রস্তুত করে। বাস্তবিকই এই পৃথিবী তাই মানুষের জন্য একটি বিরাট পাঠশালাস্বরূপ, যেখান থেকে সে দিবা-রাত্র শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।

শিক্ষা: মানুষ মানুষের মতো জীবন যাপন করে শিক্ষাকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। আর এই শিক্ষা সে গ্রহণ করে প্রকৃতিগতভাবেই, কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়াই। মানুষের এই শিক্ষা প্রক্রিয়া চলে জীবনব্যাপী অর্থঃ াৎ জš§ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।

 

বিনয় উন্নতির পথে প্রধান সোপান বিনয়ে মানব হয় মহামহীয়ান : ভাবসম্প্রসারণ

মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষের মধ্যে এমন কতগুলো গুণাবলী দান করেছেন যার ফলে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এ সমস্ত গুণাবলীর মধ্যে বিনয় অন্যতম। তবে পৃথিবীর সকল মানুষ সমান নয়। কেননা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত গুণাবলী সবার মাঝে সমান বিকশিত হয় না। পৃথিবীতে যে জাতি যত উন্নত ও শিক্ষিত তাদের বিনয় তত বেশি। বিনীত মানুষকে বৃক্ষের সাথে তুলনা করা যায়। ফলবান বৃক্ষ যেমন ফলাভারে দম্ভ না করে নুয়ে পড়ে তেমনি জগতের মহৎ মানুষেরা দাম্ভিকতার পরিবর্তে বিনয় প্রদর্শন করে। বিনয়হীন মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য নেই। পশু যেমন যেকোনো সময় হিংস্র হয়ে উঠতে পারে তেমনি বিনয়হীন মানুষেরাও বিবেকহীন নিষ্ঠুরতায় মেতে ওঠে। বর্তমান যুগে শিক্ষাকে উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে ধরা হয়। শিক্ষায় আচরণের কাক্সিক্ষত ও ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। আর এই কাঙ্ক্ষিত ,পরিবর্তন বলতে মূলত বিনয়কেই বোঝানো হয়। সুতরাং এ কথা পরিষ্কার করে বলা যায় যে বিনয় ব্যতিত মানবিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (স.) সহ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত সকল মহৎ ব্যক্তি ও দার্শনিকগণ বিনয়ের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। পৃথিবীর সকল ধর্মের মূলনীতির মধ্যে বিনয় স্থান পেয়েছে। বিনয় না থাকলে এই পৃথিবী মস্ত বড় কসাইখানায় পরিণত হত। মানুষে মানুষে হানাহানি, সংঘর্ষ, খুন, রাহাজানি ইত্যাদি বেড়ে যেত। ফলে সমগ্র পৃথিবী অস্থিতিশীল হয়ে উঠত। আর স্থিতিশীলতাই উন্নয়নের চাবিকাঠি। মানুষ তখনই মহৎ হয় যখন তার আচার-আচরণে যথেষ্ট বিনয় প্রকাশ পায়।

শিক্ষা: মনুষ্যকূলে জš§গ্রহণ করলেই তাকে মানুষ বলা যায় না। প্রকৃত মানুষ হতে হলে তার চরিত্রে অবশ্যই বিনয় থাকা চাই। সৎ, পরিশ্রমী ও বিনয়ী ব্যক্তিরাই জীবনে সফল হতে পারে।

 

বলিতে না পার যাহা চোখের উপরে বলিওনা বলিওনা তাহা অগোচরে : ভাবসম্প্রসারণ?

সমাজে ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ, উঁচু-নীচু, বোকা-ধূর্ত প্রায় সব ধরণের মানুষ বাস করে। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেক মানুষকেই পরস্পরের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়। প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র স্বভাবের অধিকারী। সেক্ষেত্রে একজনের কাছে অন্যজনের কোনো একটি বৈশিষ্ট্য খারাপ লাগতেই পারে। কিন্তু তাই বলে ঐ ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে সেটি নিয়ে নিন্দা বা সমালোচনা করা উচিত নয়। প্রতিটি ধর্মেই পরনিন্দা করতে নিষেধ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা পরনিন্দা করাকে মৃত ভাইয়ের গোস্থত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। অন্যদিকে, হযরত মুহম্মদ (স.) বলেন- ‘পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ পরনিন্দা কেবল ধর্মেই নিষিদ্ধ নয়, এটি সমাজের জন্যও ক্ষতির কারণ। পরনিন্দাকারী সমাজের শান্তি নষ্ট করে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। মহৎ এবং উদার মনের ব্যক্তিরা কখনো পরচর্চা করেন না। বরং অন্যের , দোষত্রুটি যথাসম্ভব গোপন রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু সংকীর্ণমনা কিছু মানুষ অন্যের দোষ ত্রুটি নিয়ে কুৎসা রটনা করে আত্মসুখ লাভ করতে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। পরচর্চারত থেকে সে কেবল সমাজেরই ক্ষতি করে না, একই সাথে নিজের হীনতা, নীচতা এবং নিকৃষ্টতা প্রকাশ করে। পরনিন্দাকারী ব্যক্তিকে সবাই এড়িয়ে চলে। প্রকৃতপক্ষে অন্যের দোষত্রুটি প্রচার করে বেড়ানোর মধ্যে কোনো গৌরব নেই। সমাজে শান্তি বজায় রাখতে এবং নিজেকে সমাজের সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে পরনিন্দা পরিহার করতে হবে। কোনো ব্যক্তির দোষত্রুটি চোখে পড়লে সেটি ঐ ব্যক্তিকে সরাসরি এবং নম্রভাবে, বিনয়ের সাথে বুঝিয়ে বলা উচিত। কিন্তু বুঝিয়ে বলা সম্ভব না হলেও কোনো অবস্থাতেই ঐ ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে অন্যের সাথে সমালোচনা করা উচিত নয়। এতে সমাজের শান্তি এবং পারস্পরিক সুসম্পর্ক নষ্ট হয়।

শিক্ষা: মানুষ মাত্রই দোষত্রুটি থাকবে। তা মেনে নিয়েই পরস্পর মিলেমিশে সমাজে বাস করতে হয়। সমাজে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করতে হলে ভালোকে প্রশংসা করার এবং মন্দের দোষত্রুটি গোপন রাখার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। মন্দ লোকের দোষত্রুটি প্রচার করে বেড়ানোর মধ্যে কোনো মহত্ত্ব নেই। ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার দোষত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

ফ্যাশনটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী : ভাবসম্প্রসারণ

সৃষ্টি ও ধ্বংসের সুপরিকল্পিত প্রভাবে গড়ে ওঠেছে আমাদের আজকের যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি। সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে প্রতিটি জাতিই কম বেশি অনুকরণ করে থাকে। তাই সভ্যতার ধারক ও বাহক মানুষও অনুকরণপ্রিয়। তবে অনেক সময় মানুষ অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমে তার নিজস্বতা ও স্বাতন্ত্র্য ভুলে যায়। কোনো জাতি যদি কখনো তার নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ভুলে যায়, অনুকরণে নিজের আত্মতৃপ্তি খুঁজে পায়, তখন তার অন্তরের হীনতাই প্রকাশ পায়। কারণ প্রতিটি জাতির নিজস্ব সত্তার সাথে তার কৃষ্টি সংস্কৃতি, সভ্যতার যোগ অভিন্ন। কারণ একটি জাতির বৃহৎ অর্জনগুলো সংস্কৃতি ও সভ্যতার দ্বারাই নির্ণীত হয়। তাই মানুষের অন্ধ অনুকরণপ্রিয়তা একটি জাতির জন্য নীতি বিগর্হিত কাজ। এটা আসলে মুখোশের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখার মতোই। তবে অনুকরণ সবক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না। অন্যের ভালো গ্রহণ করা বা চর্চা করা কোনো দূষনীয় বিষয় নয়। কারণ এ সমাজ সংসারে উন্নত জাতির কাছ থেকে গ্রহণ করার মতো অনেক কিছু আছে। তবে আমাদের কাজ হলো তাদের মন্দটুকু বাদ দিয়ে ভালোটুকু যা আছে তা গ্রহণ করা। আর এ কাজটি যদি আমরা সফলভাবে করতে পারি এবং তা আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে আত্তীকরণ করি তাহলে আমাদের দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকরই হবে। এতে আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি অনেক বেশি পরিমার্জিত এবং পরিশোধিত হবে। সর্বদাই খেয়াল রাখতে হবে আমরা যেন আমাদের শিকড়কে ভুলে না যাই। যেকোনো বিষয়কে ভাল-মন্দ বিচার করে অনুকরণ বা অনুসরণ করলে মানুষের নিজস্ব চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটে। সমস্যা হয় তখনই যখন আমরা ভালোমন্দ বিচার না করে অন্ধভাবে অপরকে অনুকরণ করতে থাকি। এতে ব্যক্তির হীনতা তৈরি হয় এবং নিজের স্বকীয়তা ধ্বংস হয়। তাই নিজের হীনতা-দীনতা প্রকাশ না ঘটিয়ে স্বকীয়তা প্রকাশ করাই আমাদের কর্তব্য।

শিক্ষা: অপরের অনুকরণের মুখোশ না পরে নিজের ব্যক্তিত্বকে নিজের মতো করে বিকশিত করতে হবে। নিজের ব্যক্তিত্ব, পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ করা অনেক জটিল হলেও আমরা নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে এ কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারি।

 প্রয়োজন ব্যতিত বন্ধু শত্রু চেনা যায় না : ভাবসম্প্রসারণ?

মানুষ সামাজিক প্রাণী বলে একাকি বাস করতে পারে না। তাকে সমাজে বাস করতে হয়। জন্মের পর থেকেই মানুষ অসহায়। সংগ্রাম করে তাকে জীবনযাপন করতে হয়। জীবন সংগ্রামের পথে মানুষকে সমাজের মানুষের সাথে মিশতে হয়। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে কারো কারো সাথে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠে। যারা প্রকৃত বন্ধু, শুভাকাঙ্খী তারা মানুষের ভালো চায়, কল্যাণ কামনা করে। আর যারা শত্রু তারা অপরের অমঙ্গল কামনা করে, ক্ষতি করার চেষ্টা করে। মানুষের জীবনে সুসময় এবং দুঃসময় পর্যায়ক্রমে আসে। সুসময়ে বন্ধু এবং শত্রু কাউকে চেনা যায় না। সবাই তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বন্ধুত্বের বুলি শুনায়। মানুষ যখন বিপদে পড়ে, যখন প্রয়োজন হয়, তখন বন্ধুত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রকৃত বন্ধুরা বিপদের সময় কখনও ছেড়ে যায় না। যারা বিপদের মুখে বন্ধুকে রেখে পালিয়ে যায় তারা বন্ধুরূপী শত্রু। তারা বসন্তের কোকিলের মতো জীবনে আসে। তারা আসে শুধু তাদের প্রয়োজনেই। তারা আসলেই স্বার্থপর। এসব স্বার্থপর লোক বন্ধু হতে পারে না। স্বার্থপর বন্ধু ও শত্রু দুর্দিনে বা সংকটকালে স্পষ্ট হয়ে যায়। তারা বিপদের সময় এগিয়ে আসে না, বরং বিপদে ফেলে চলে যায়। একমাত্র প্রয়োজনের সময়ই বন্ধু ও শত্রু আলাদাভাবে নিরূপন করা যায়। প্রয়োজনই বন্ধু ও শত্রু চেনার পরিমাপক।

শিক্ষা: বন্ধু নির্বাচন করতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বন্ধু জীবনে চলার পথে অপরিহার্য অঙ্গ। অপ্রকৃত বন্ধুদের থেকে দূরে থাকতে হবে।

প্রথম যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে তুমি মাত্র কেঁদেছিলে, হেসেছিল সবে এমন জীবন হবে করিতে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন : ভাবসম্প্রসারণ?

প্রত্যেক শিশুই জন্ম গ্রহণ করে একইভাবে। একই শারীরিক গঠন নিয়ে। তাই সবাই শিশুর জন্মের সংবাদে সমানভাবে খুশি হয়। প্রত্যেকেই জšে§র পর অসহায় এবং পরনির্ভরশীল থাকে। ক্রমে ক্রমে নিজের পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে শেখে। এক সময় নিজের বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে জীবন চালানোর সক্ষমতা অর্জন করে। কেউ সৎ কাজ করে, কেউ অসৎ কাজ করে। কেউবা নিজের স্বার্থে কাজ করে, কেউ আবার মানবজাতির স্বার্থে কাজ করে। যারা সৎ গুণাবলী অর্জন, কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে পৃথিবীর সব জীবের কল্যাণসাধন করে, তারাই জগৎশ্রেষ্ঠ। যারা মানবতার কল্যাণে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে, তারা তাদের কর্মের দ্বারা পৃথিবীকে আরো সুন্দর করে তোলে। মহৎ মানুষ নিজের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে দেশ ও জাতির কল্যাণার্থে। জীবনের মূল্যবান সময়ে সুখ-আহলাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখে শুধু মানব কল্যাণে। এমন মহৎ, আত্মত্যাগী মানুষদের মৃত্যুতে সব দেশের সব মতের, সব ধর্মের মানুষ সমানভাবে ব্যথিত হয়। গোটা জাতি দুঃখে শোকে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কিন্তু যে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না, তাদের দিয়ে দেশ জাতির কোনো কল্যাণ হয় না। বরং ঐসব স্বার্থপর মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। তারা নিজের সুখের জন্য সব ধরণের অন্যায় করে, দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হত্যা, চোরাচালান, যুদ্ধ, সংঘর্ষ ইত্যাদি অপরাধ কর্ম তাদের দ্বারাই সংঘটিত হয়। এসব অপরাধী মানবজাতির কলঙ্ক। সবাই তাদের ক্ষমতাকে ভয় করলেও মন থেকে সম্মান করে না। যখন তাদের মৃত্যু হয় তখন তাদের ক্ষমতারও অবসান হয়। তাদের মৃত্যুতে কেউ দুঃখিত হয় না। অশ্রু বিসর্জন তো দূরের কথা, ঐসব স্বার্থপর মানুষদের মৃত্যুতে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। কারণ তারা হাজার বছর বেঁচে থকলেও মানবজাতির ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হতো না।


শিক্ষা: নিজের জন্য হাজার বছর বেঁচে থাকার মধ্যে সার্থকতা নেই। জীবনে সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় মানব কল্যাণে একদিন বেঁচে থাকার মধ্যেও। যারা সৎ চিন্তা, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সব সৃষ্টির কল্যাণসাধন করে, তারা মানবজাতির মন জয় করতে পারে, তাদের মৃত্যু সবাইকে ব্যথিত করে। 

মধুর চেয়েও আছে মধু, সে এই আমার দেশের মাটি, আমার দেশের পথের :ধূলা, খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি

 ,

জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সীঅর্থঃ াৎ জন্মভূমি স্বর্গের থেকেও শ্রেষ্ঠ। মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন-কল্পনা সবকিছুর মধ্যে স্বদেশ চেতনার বীজ নিহিত। নিজের মায়ের প্রতি ভালোবাসা যেমন মানুষের š§লব্ধ বৈশিষ্ট্য, তেমনি জন্মভূমির প্রতি টানও মানুষের সহজাত। দেশের আলো, বাতাস, ধূলিকণার প্রতি মানুষ একটা সুতীব্র ভালোবাসা অনুভব করে। দেশের মাটি, পানি দেহকে শীতল উৎফুল্ল করে, দান করে অফুরন্ত প্রাণশক্তি। দেশ-মাতা গর্ভধারিনী মায়ের মতোই নিজের সুশীতল ছায়ায় মানুষকে বড় করে তোলে। স্বদেশ ছেড়ে কিছুদিন বাইরে থাকলে মানুষের মন ছটফট করে নিজ দেশের জন্য। দেশের সাথে প্রত্যেক মানুষ যেন এক স্বর্গীয় বন্ধনে আবদ্ধ। স্বদেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন প্রকৃত সার্থকতা লাভ করে। প্রকৃত দেশপ্রেমিক তার দেশের মানুষ, ভূপ্রকৃতি সবকিছু নিয়েই চিন্তা করে। সকলের উপকারে নিজেকে নিয়োজিত রাখে। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। দেশের উন্নয়নে নিজ দেশকে গোটা পৃথিবীর কাছে পরিচিত করতে তারা সবসময় কাজ করে যায়। দেশপ্রেমের দীক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে ১৯৭১ সালে আমাদের দেশমাতৃকার বীরসন্তানরা যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা। দেশপ্রেমের এমন আরো অনেক দৃষ্টান্ত ইতিহাসে দেখা যায়। দেশপ্রেম মানুষকে সাহস দেয়, শক্তি দেয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। নিজ দেশের প্রতি যার ভালোবাসা নেই, সে সত্যিকার মানুষ হতে পারে না। দেশের মানুষের কষ্ট হাহাকার যার হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পারে না সে পশুর সমান

শিক্ষা: দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। যে মানুষ তার দেশকে ভালোবাসে না তার জন্ম বৃথা। তাই আমাদের উচিত নিজ দেশকে ভালোবাসা দেশের কল্যাণে নিয়োজিত থাকা

 

নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভাল, যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো

মানুষ মাত্রেই ভুল করে। আর সেই ভুলের সুযোগ নেয় নিন্দুক। মানুষের ছোট বড় দোষ ত্রুটি নিয়ে কুৎসা রটনা করে বেড়ানোই নিন্দুকের কাজ। ফলে আমরা নিন্দুকের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। প্রকৃত পক্ষে নিন্দুক আমাদের ক্ষতির চেয়ে উপকারই বেশি করে। আমাদের দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে নিন্দুক আমাদেরকে খাঁটি মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। নিন্দুকেরা মানুষের ভুল গুলো নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠে। এর দ্বারা মূলত ভুলকারী ব্যক্তিকে সে সচেতন করে তোলে যা প্রকৃত অর্থঃ েই ইতিবাচক। যে ব্যক্তি বন্ধুর ভুল ধরিয়ে না দিয়ে কেবল প্রশংসা করে চলে, সে কখনই প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না। কারণ বন্ধুর এক তরফা প্রশংসা তার জীবনকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে। কিন্তু নিন্দুক সারাক্ষণই ওঁৎ পেতে থাকে, মানুষ কখন কি ভুল করে, সেই ভুলের সূত্র ধরে সে নানা কথা বলে বেড়ায়। সকলের কাছে নিন্দা করে বেড়ায়। ফলে নিন্দুকের ভয়ে মানুষ সাবধান থাকে। সকল প্রকার দোষ ত্রুটি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। কোনো কাজ করার আগে নিন্দুকের ভয়ে মানুষ অনেক বার চিন্তা করে। নিন্দুক যদি না থাকত, তাহলে মানুষ কোনো ভুল করার আগে চিন্তা করার প্রয়োজনবোধ করতো না। তাই মানুষকে ভুল থেকে দূরে রাখতে এবং অকল্যাণ কর্মতৎপরতা থেকে মুক্তি দিতে নিন্দুকের তুল্য কেউ নেই

শিক্ষা: নিন্দুক আমাদের ভুল ধরিয়ে দিয়ে সংশোধিত হবার সুযোগ করে দেয়। ফলে আমাদের ব্যক্তি জীবন সমাজজীবনে ত্রুটি বিচ্যুতির পরিমাণ অনেকাংশেই কমে যায়

নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?

সম্প্রসারিত ভাব মানব সভ্যতার বিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার হলো আগুন। প্রাচীনকালে মানুষ পশুর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। মানুষ পশুর মতো কাঁচা মাংস খেত। আগুনের আবিষ্কার সবকিছু বদলে দিয়েছিল। আগুন আবিষ্কারের ফলে মানুষ খাবার সিদ্ধ করে খেতে শেখে। আগুনে পুড়িয়ে বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করতে শেখে, বন্য প্রাণীকে ভয় দেখাতে আগুন ব্যবহার করতে শেখে। সর্বোপরি আগুন আবিষ্কারের ফলে মানুষের জীবনযাত্রাই পুরো পাল্টে গিয়েছিল। সভ্যতার প্রতিটি আবিষ্কারেই আশীর্বাদের পাশাপাশি কিছু অভিশাপ থাকে। আগুন এমন একটি পদার্থ যার সাধারণ ধর্ম হলো দহন। ভুল করে আগুনে হাত দিলেও আগুন পোড়াতে ভুল করবে না। আগুনের কাছে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট সবই সমান। আমাদের সমাজ জীবনেও আগুনের মতো কিছু ধ্বংসাত্মক জিনিস রয়েছে। সমাজে যখন কোনো অপরাধ দানা বাঁধে তখন তা গোটা সমাজকেই গ্রাস করে। সমাজে ভাল-মন্দ উভয় শ্রেণির মানুষই থাকে। তথাপি অন্যায়ের জোরই বেশি। আগুন অপরাধ দুটো বিষয়ের মধ্যে একটি মিল রয়েছে। উভয়ই ছোট থেকে বড় হতে থাকে এবং ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আগুনের যেমন দহন ছাড়া কোনো ধর্ম নেই, তেমনি অপরাধেরও ধ্বংস ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম নেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আগুন রূপে অপরাধকে বিঘ্নত হতে দেখি। আগুনের মতোই অপরাধ ভালো-মন্দ সব কিছুকেই গ্রাস করে। কারো প্রতি তার পক্ষপাত নেই

শিক্ষা: আগুন অপরাধ অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন যেমন ভাল-মন্দ সবকিছু পোড়ায়, তেমনি অন্যায় পাপকে গ্রহণ করে ভালোকে ধ্বংস করে দেয়। সুতরাং ব্যক্তি সমাজজীবনে অপরাধ যত দ্রুত সম্ভব প্রতিরোধ করতে হবে


দুর্নীতি জাতির সকল উন্নতির অন্তরায়

পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির জাতীয় উন্নয়নের প্রধান বিষয়গুলো হলো- মানব উন্নয়নে বিনিয়োগ, রাজনীতিতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা। জাতীয় জীবনের উন্নতির জন্য প্রত্যেক জাতিকে তাই সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে হয়। ন্যায়নীতি, সততা ও স্বচ্ছতা জাতিকে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। পৃথিবীর ইতিহাসে সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও পরিশ্রমী জাতিই উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে। কিন্তু জাতীয় জীবনে দুর্নীতি প্রবেশ করলে জাতির সকল উন্নতির পথ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ দুর্নীতি হলো অপরাধমূলক খারাপ কাজ যা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও আদর্শের পরিপন্থী। দুর্নীতি জাতির সকল অর্জনকে এবং জাতীয় উন্নয়নের সকল সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। অন্যায় ও দুর্নীতির কারণে জাতি নানাবিধ অনাচার, হিংসাত্মক ও অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়। জাতি তখন জাতীয় উন্নতির কথা ভুলে গিয়ে ব্যক্তিগত হীনস্বার্থ লাভের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে। ফলে জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে দুর্নীতি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দুর্নীতিবাজ মানুষ প্রতিনিয়ত ভাবে কীভাবে অন্যের সাথে প্রতারণা করে নিজের লাভের পরিমাণ বাড়ানো যায়। ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনে দুর্নীতিবাজরা বলপ্রয়োগ, ভয়প্রদর্শন ও ঘুষ প্রদান করে থাকে। দেশ, জাতি ও মানবকল্যাণের কথা দুর্নীতিবাজের চিন্তায় আসে না। , অসহায় ও দরিদ্রদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য যে সম্পদ ব্যবহৃত হওয়া উচিত তা দুর্নীতিবাজরা নিজেদের পকেটে ঢোকায়। এতে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির বদলে অসহায় ও দরিদ্রের সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যায়। দুর্নীতির করাল গ্রাসে একটি সম্ভাবনাময় জাতির ভবিষ্যৎ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। দুর্নীতি সামাজিক বৈষম্য, স্বার্থপরতা, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্র প্রভৃতির মাধ্যমে জাতীয় অনৈক্য ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এই সর্বনাশা সামাজিক ব্যধির মরণ ছোবল থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে পারলেই জাতির উন্নয়ন সম্ভব। এজন্য প্রত্যেক জাতিকে দুর্নীতির ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। দুর্নীতি সৃষ্টির কারণ খুঁজে বের করতে হবে। দুর্নীতি মোকাবিলায় সবাইকে এক সাথে কাজ করতে হবে।

শিক্ষা: সর্বনাশা ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতির মূল উৎপাটন করে জাতীয় উন্নয়নের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধিশালী ও মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব। তাই দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করে জাতির উন্নয়নে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

দন্ডিতের সাথে দন্ড-দাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার

পাপ-পূণ্য নিয়েই মানুষের জীবন। যিনি ন্যায়বান তাকে সবাই পছন্দ করেন। অপরদিকে অন্যায়কারী ব্যক্তিকে তার অপরাধের জন্য বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। তাকে শাস্তি পেতে হয়। তবে অনেক সময় দেখা যায় বিচার সঠিক হয় না। আবার একজনের অপরাধে অন্যজন দন্ড প্রাপ্ত হয়। এক্ষেত্রে বিচারককে সুকঠিন ও অত্যন্ত বিচক্ষণ হতে হয়। তিনি তার প্রজ্ঞা ও মেধার সাথে সহানুভূতি ও মমত্ববোধের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে দন্ড দান করবেন। দন্ডের ভয়ে অনেক সময় অপরাধী পাপকর্ম থেকে দূরে থাকে কিন্তু তার মানসিকতার পরিবর্তন হয় না। এ জন্য বিচারককে দয়া প্রদর্শন ও সহানুভূতির মাধ্যমে অপরাধীর বিবেককে জাগিয়ে তুলতে হবে এবং তাকে দন্ড দিতে হবে। বিচারক মানবিক বিবেচনা ও সাক্ষ্য প্রমাণের সমন্বয়ের মাধ্যমে বিচারকার্য করবেন। এতেই অপরাধীর অন্তরে অন্যায়ের প্রতি ঘৃণাবোধ জন্মাবে। অপরাধীকে শাস্তি নয় বরং তাকে সঠিক পথে আনাই বিচারকের মূল লক্ষ্য। এতে সমাজে অপরাধ কমে আসবে। শুধুমাত্র কঠোরতা নয় দয়া, মমত্ববোধ, নমনীয়তা প্রভৃতি বিষয়ের নিশ্চবয়তাই সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারের নিদর্শন।

শিক্ষা: পবিত্র বাইবেলে রয়েছে ‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়’। তাই অপরাধীকে শুধু শাস্তি দিলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। বরং তার ভেতরের মানুষটাকে সজাগ করে তার মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলাই সমাজ ও জাতির কর্তব্য।

তোমার মাপে হয়নি সবাই, তুমিও হওনি সবার মাপে তুমি মর কারো ঠেলায়, কেউ-বা মরে তোমার চাপে

 ,

মানুষের চাহিদা অফুরন্ত। এই অফুরন্ত চাহিদা পূরণে মানুষ পরস্পরের সাথে এক বিচিত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। একে অপরকে পেছনে ফেলার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। এভাবে অন্যের প্রতি লোভ ও ঈর্ষা মানুষকে করে তোলে আক্রমণাত্মক। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অন্যের ক্ষতি করতেও মানুষ পিছপা হয় না। কোনো মানুষই সর্বগুণ সমৃদ্ধ নয়। দৈহিক সৌন্দর্য ও ধন সম্পদ সবার সমান থাকে না। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এ বাস্তবতা মেনে নিতে পারে না। তাই প্রত্যেক মানুষই নিজের অবস্থানে হয় অসুখী। যা নিজের নেই সেটার প্রতিই মানুষের আকর্ষণ তীব্র। এই না থাকা জিনিসগুলো অর্জন করার জন্য মানুষ ব্যগ্র হয়ে ওঠে। আমৃত্যু মানুষ ছুটতে থাকে স্বপ্ন পূরণের আশায়। একটি স্বপ্ন পূরণ হলে আবার ধাওয়া করে অন্য স্বপ্নের পেছনে। এভাবে মানুষের আকাখ্ক্ষা শুধু বাড়তেই থাকে। এর কোনো শেষ হয় না। যেন অবিরাম চলছে মানুষের পাওয়া না পাওয়ার যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে মানুষ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। সবাই মনে প্রাণে চেষ্টা করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে নিজে বিজয়ী হতে। এই বিজয়ের নেশায় মানুষ তার বিবেক, বুদ্ধি, মনুষ্যত্ব সব বিসর্জন দেয়। নিজের চাহিদা মিটাতে অন্যের ওপর চালায় নির্যাতন। অপরকে পদদলিত করে নিজের অবস্থানে পৌঁছাতে দ্বিধাবোধ করে না।

শিক্ষা: স্বল্প পরিসরের এই জীবনে মানুষ যদি শুধুমাত্র অর্থঃ -সম্পদ, মান-মর্যাদা অর্জনের পেছনে ছুটতে থাকে তাহলে তারা এই সুন্দর পৃথিবীর কোনো আনন্দ উপভোগ করতে পারবে না। তাই মানুষের উচিত নিজের যা আছে তাই নিয়েই সুখী হওয়ার চেষ্টা করা।

জাতীয় অবিচার জাতীয় পতনের নিশ্চিত কারণ

 ,

আইনের শাসনের অভাব জাতীয় অবিচারের মূল কারণ। আর জাতীয় অবিচার দেশ ও জাতিকে পতনের দিকে ঠেলে দেয়। সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার ফলে জাতীয় অবিচার উদ্ভব হয়, যা ক্রমেই সকল পেশার মানুষের মধ্যে প্রবাহিত হয়। জাতীয় অবিচারে উৎসাহিত হয়ে বিভিন্ন পেশার মানুষও স্বেচ্ছাচারি হয়ে ওঠে। কেউ কোনো প্রকার অন্যায় করতে ভয় করে না। যে যার জায়গা থেকে কর্তব্যে অবহেলা করে। দুর্নীতিতে জর্জরিত হয় দেশ। জাতীয় অবিচারের ফলে অপরাধী বড় অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। প্রতিটি মানুষ অপরাধের প্রতি উৎসাহিত হয়। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কলহ বেড়ে যায়। অর্থঃ নৈতিক অবস্থা, শিক্ষার জগতের উন্নতি মুখ থুবড়ে পড়ে। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ইত্যাদি দিন দিন বাড়তে থাকে। মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকে না। প্রতিটি মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত কাটে আতঙ্কে। আইনের শাসন না থাকলে জনগণের সকল কার্যক্রমে তার খারাপ প্রভাব পড়ে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালত ক্ষমতার অপব্যবহার করা শুরু করে। ফলে দেশের সব ধরণের উন্নতি স্থবির হয়ে পড়ে। জোর যার মুল্লুক তার এর ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হয়। যার ফলে জাতির জীবনে পতন নেমে আসে। অন্ধকারে ঢাকা পড়ে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ ।

শিক্ষা: দেশ ও জাতির উন্নতির জন্য ব্যক্তি ও সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করা প্রয়োজন। আইন শাসন প্রতিষ্ঠা করা অনিবার্য। তাহলে দেশ ও জাতি নিশ্চিত পতনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

 

জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?

সৃষ্টিকর্তা এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন সবুজ শ্যামলে সুন্দর করে সাজিয়েছেন পৃথিবী তবে তার সেরা সৃষ্টি হলাম আমরা মানুষ জাতি তিনি আমাদেরকে জীবন দিয়েছেন আমাদের জীবন বড় ক্ষণস্থায়ী আর তা আটকে আছে সুনির্দিষ্ট বাঁধাধরা কিছু নিয়মে এই জীবনের আয়ু অসীম নয়, অনন্তকালের নয়, এর শেষ আছে আমাদের জীবন অবিনশ্বর নয় বরং তা নশ্বর জীবনের শুরু হয় জন্ম দিয়ে আর এর পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর মাধ্যমে যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু নিশ্চিত পৃথিবীতে এমন কোনো সৃষ্টি নেই, যার জন্ম হয়েছে কিন্তু মৃত্যু হবে না মৃত্যুকে থামানো যায় না বলেই মানুষ কখনো অমর হতে পারে না মানুষের পঁচনশীল শরীর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে মিশে যায় পৃথিবীর মাটিতে মানুষ হয়তো অন্যের স্মৃতিতে বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু স্বশরীরে কেউ কোনোদিন অমর হতে পারে না মানুষ মৃত্যুকে না চাইলেও মৃত্যুই মানুষকে কেঁড়ে নিয়ে যায় এই সুন্দর বসুধা থেকে মৃত্যু কাউকে কখনো অমর হতে দেয় না মৃত্যু প্রত্যেক জীবের জন্য অবধারিত সত্য সৃষ্টিকর্তা নির্দিষ্ট সময় বেধে দিয়ে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন কখনোই এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি, ঘটে না আর ঘটবেও না মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় কিন্তু অমর থেকে যায় কেবল তার সৃষ্টিকর্ম

শিক্ষা: মানুষ মরণশীল, প্রতিনিয়ত সে মৃত্যুর দিকে ধাবমান। মৃত্যু এড়িয়ে অমর হওয়া তাই অসম্ভব

 

জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষ জাতি, একই পৃথিবীর স্তন্যে লালিত, একই রবি-শশী মোদের সাথী

 ,

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, মানুষ “আশরাফুল মাখলুকাত” অর্থঃ াৎ সৃষ্টির সেরা। অন্যদিকে, বাইবেলে আছে, "God made man after His own image." প্রতিটি ধর্মেই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। স্রষ্টার সৃষ্টিতে জাতি, ধর্ম, বর্ণের কোনো ভেদাভেদ নেই। তিনি প্রত্যেক মানুষকেই মেধা, মনন ও হৃদয় এর সমন্বয়ে অনন্য সাধারণ করে সৃষ্টি করেছেন। সভ্যতার শুরু থেকে এ পর্যন্ত মানুষ প্রতিটি পর্যায়ে তার এই শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়ে আসছে। মূলত মানবগোষ্ঠীর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আলাদা আলাদা কোনো পরিচয় নেই। প্রকৃতপক্ষে, মানুষের একমাত্র পরিচয় হলো সে মানুষ। সে পৃথিবীর যেকোনো দেশের অধিবাসী হোক, যেকোনো ধর্মাবলম্বী হোক, সাদা-কালো-তামাটে যে বর্ণের হোক, ধনী-গরীব যে শ্রেণীরই হোক, নারী হোক কিংবা পুরুষ এগুলো তার প্রকৃত পরিচয় নয়। তার সত্যিকার পরিচয় হচ্ছে মানব পরিচয়। বৈষ্ণব কবি চন্ডীদাস তাই যথার্থই বলেছেন- “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।” কিন্তু নিচু মনের অধিকারী মানুষেরা এই সত্যকে মানতে চায় না। তারা নিজেদের স্বার্থে পৃথিবীতে জাতভেদ, বর্ণবৈষম্য, শ্রেণিবৈষম্য প্রভৃতি কুপ্রথা তৈরি করেছে। এ ধরণের স্বার্থপর মানুষেরা নিজেদের অর্থঃ -বিত্তের দম্ভে দরিদ্র, অসহায় মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সমাজে কৃত্রিম শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করতে সচেষ্ট। সকল মানুষ একই পৃথিবী হতে উৎপন্ন খাদ্য গ্রহণ করে, একই চন্দ্র, সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়। তাই প্রকৃতপক্ষে মানুষের আলাদা কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ পরিচয় নেই, মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এটিই তার সর্বশ্রেষ্ঠ এবং একমাত্র পরিচয়।

শিক্ষা: পৃথিবীর সকল ধর্ম-কর্ম, মত ও পথের ঊর্ধ্বে মানুষের স্থান। সামান্য অর্থঃ -সম্পদ কিংবা জাতি, ধর্ম, বর্ণের মাপকাঠিতে মানুষকে উঁচু-নিচু শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় না। সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ, যে হৃদয়ধর্মে উদার এবং মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ না রেখে মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখে।

চরিত্রহীন মানুষ পশুর সমান ,

মানব জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট , গুণাবলির মধ্যে চরিত্র অন্যতম। এটি মানব জীবনের ভূষণ হিসেবে কাজ করে। কথায় আছে, ‘সম্পদ হারালে কোনো ক্ষতি হয় না, স্বাস্থ্য হারালে কিছুটা ক্ষতি হয় কিন্তু চরিত্র হারালে সব কিছুই খোয়া যায়।’ তাই বিখ্যাত ইংরেজ লেখক স্যামুয়্যাল স্মাইলস তাঁর "Character" ,নিবন্ধে বলেছেন- "The crown and glory of life is character." , মনীষী বাকী বলেছেন- ‘অর্থঃ ের প্রয়োজন নেই, পদমর্যাদার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন আছে শুধু চরিত্রের, যা মানুষের জীবনের সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়।’ বস্তুত চরিত্র শ্রেষ্ঠ সম্পদ। নামমাত্র নৈতিকতা বা ন্যায়নিষ্ঠাই চরিত্র নয়। চরিত্রের মধ্যে সমন্বয় ঘটবে মানুষের যাবতীয় গুণাবলি ও আদর্শের। সততা, সত্যনিষ্ঠা, প্রেম, পরোপকারিতা, দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা এবং কর্তব্যপরায়ণতা হলো চরিত্রের মৌলিক উপাদান। এসব সদগুণ তাকে চরিত্র শক্তিতে বলীয়ান করে তোলে। স্পর্শ-মণির ছোঁয়ায় লোহা যেমন সোনায় পরিণত হয়, তেমনি সচ্চরিত্র মানুষের পশুবৃত্তি ঘুচিয়ে দেয়। সে হয়ে ওঠে বিবেকের কাছে কলুষমুক্ত, পরোপকারী, নির্লোভ, ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের সেবক। কিন্তু চরিত্র শক্তিতে বলীয়ান না হলে মানুষ সহজেই অপকর্মে লিপ্ত হয় নৈতিক অধঃপতন ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হলেও সে জাতির জীবন হয়ে ওঠে কলঙ্কিত। চরিত্রহীন লোককে সবাই ঘৃণা করে, সমাজের কারো কাছে এদের দাম নেই। এরা সমাজের কোনো উপকারে , আসে না, বরং ক্ষতি করে। এ জন্য সবাই তাদের এড়িয়ে চলে। চরিত্র দোষেই তাদের স্থান হয় পশুস্তরে। পক্ষান্তরে চরিত্রবান লোক কেবল জীবনে মহত্ত্বই অর্জন করেন না, মৃত্যুর পরও তারা স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকেন। সচ্চরিত্র বলে তারা সমাজ ও জাতীয় জীবনের অগ্রগতি ও উন্নতির পথে আলোকবর্তিকার মতো কাজ করেন। পৃথিবীর সকল ধর্মগুরু ও মনীষীগণ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বস্তুত সচ্চরিত্রের কারণেই মানুষ হয় মহৎ, গৌরবান্বিত মর্যাদার অধিকারী। তা না হলে তার স্থান হয় নিম্নস্তরে। স্বাস্থ্য, অর্থঃ , বিদ্যা মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ করে তুলতে পারে না। পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে তাকে সচ্চরিত্রবান হতে হয়। এজন্য প্রতিটি মানুষের সচ্চরিত্র ভালো মানস গঠনের সহায়ক আর ভালো মানস ভালো সমাজ ও জাতি গঠনের সহায়ক। চরিত্রহীন জনগোষ্ঠী জাতির উন্নতির অন্তরায়।

শিক্ষা: মানব জীবনে চরিত্র অমূল্য সম্পদ। কোনো মূল্যেও এর পরিমাপ করা যায় না। চরিত্রের কারণেই মানুষ পশুত্ব থেকে মুক্তি পায়, অর্জন করে সত্যিকারের গৌরব ও মর্যাদা।

 

গ্রন্থগত বিদ্যা আর পর হস্তে ধন নহে বিদ্যা, নহে ধন হলে প্রয়োজন ,

মানুষের জ্ঞানের ধারক ও বাহক হচ্ছে গ্রন্থ। গ্রন্থ পাঠ করে মানুষ তার জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করে, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটায়। নিজের ও অন্যের প্রয়োজনে সেই বিদ্যাকে কাজে লাগায়। বিদ্যার আলোকে জগৎকে উদ্ভাসিত করে। শাশ্বত সত্য-সুন্দরের পথ নির্দেশ করে। কিন্তু বিদ্যা যদি কেবল গ্রন্থগতই হয় তবে তা কোনো কাজেই লাগে না। গ্রন্থগত বা পুঁথিগত বিদ্যা মানুষকে যথার্থ জ্ঞানী করে তুলতে পারে না। বিদ্যাকে জীবনের উপযোগী করে তোলার মধ্যেই এর যথার্থ উদ্দেশ্য নিহিত। কাজেই তত্ত্বীয় জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারিক জ্ঞানও থাকা দরকার। বিদ্যা অর্জন করে তাকে কাজে লাগাতে হবে। কেবল মুখস্থ করে লেখাপড়া করলে তা প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা যায় না। যে জ্ঞান ব্যবহারিক জীবনে কোনো কাজে আসে না সে জ্ঞান দ্বারা নিজেরও যেমন কোনো উপকার হয় না তেমনি জগতেরও কোনো কল্যাণসাধন হয় না। আর যে বিদ্যা প্রয়োজনের সময় কাজে ব্যবহার করা যায় না প্রকৃতপক্ষে সে বিদ্যার কোনো মূল্য নেই। তেমনি মানুষের জীবনে ধন-সম্পদেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য প্রয়োজন হয় কঠোর পরিশ্রম। পরের ধন-সম্পদকে নিজের মনে করা কিংবা নিজের ধন-সম্পদ অন্যের কাছে জমা রেখে নিজের বলে হিসাব করা চরম বোকামি। কারণ অন্যের নিকট জমা রাখা ধনসম্পত্তি প্রয়োজনের সময় কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। সুতরাং সার্থক ও সুন্দর জীবনের জন্যে বিদ্যাকে যেমন আত্মস্থ করতে হবে, ঠিক তেমনি ধন-সম্পদ অন্যের কাছে অহেতুক গচ্ছিত না রেখে নিজের আয়ত্তে রাখতে হবে। যাতে বৃহত্তর মানবকল্যাণে তা কাজে লাগানো যায় তথা দেশ ও দশের মঙ্গলে ব্যবহার করা যায়।

শিক্ষা: গ্রন্থগত বিদ্যা আর অন্যের আয়ত্বে থাকা ধন কোনো প্রয়োজনে আসে না। মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হওয়ার মধ্য দিয়েই এসবের সার্থকতা।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল ,

আপাত দৃষ্টিতে একটি ক্ষুদ্র বালুকণা কিংবা এক বিন্দু জলকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় না। কারণ এর উপযোগিতা সামান্যই। কিন্তু এমন অজস্র বিন্দু বিন্দু জলই মহাসাগর সৃষ্টি করে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণাই গড়ে তোলে বিশ্বসভ্যতা। মৌমাছির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ফল বৃহৎ মৌচাক। তেমনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহৎ উদ্যোগই এনে দেয় জীবনের চুরান্ত সার্থকতা। তাই ক্ষুদ্র বলে কোনো বিষয়কেই অবহেলা করা উচিত নয়। সকল ছোট কাজই বড় কাজের প্রেরণা। সেটি ভালো কাজই হোক কিংবা মন্দ কাজ। একটি শিশুর মিথ্যা বলার অভ্যাস তার ভবিষ্যৎ জীবনকে অন্ধকারে পরিণত করতে পারে। ভবিষ্যতে মিথ্যার রূপটি আরো বৃহৎ হয়ে তার নিজের ও সমাজের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। শিশুটি যদি ছোটবেলা থেকেই সত্য বলার অভ্যাস গড়ে তোলে তাহলে তার জীবন সুন্দর হয়ে উঠবে। তাই ছোট ছোট মন্দ কাজকে অবজ্ঞা না করে তা যথা সময়ে শোধরাতে হবে। আর ভালো কাজ যতই ক্ষুদ্র হোক তাকে অনুপ্রেরণা দিতে হবে। ছাত্রজীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সফলতা একসময় মানুষকে বড় হতে সহায়তা করে। সেসময়ের ক্ষুদ্র একটি পরিকল্পনাই বদলে দিতে পারে বিশ্ব সমাজের গোটা চেহারাকে। পৃথিবীতে যারা স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন তাদের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাদেরও সফলতার মূলে রয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াস। তাই পৃথিবীর কোনো ক্ষুদ্র বিষয়ই আসলে ক্ষুদ্র নয়। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ এর সৃষ্টি।

শিক্ষা: ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে মনোযোগী হলে জীবন বৃহত্তর ব্যঞ্জনায় সার্থকতা লাভ করে। তাই ক্ষুদ্রকে তুচ্ছ জ্ঞান না করে বরং সেটি পরিচর্যার মাধ্যমে জীবনের সাফল্যকে ছিনিয়ে আনতে হবে।

 

 কৃষ্ণ বলিয়া যারে তুমি আজি কর হীন অপমান রুধির তাহারো নহেত কৃষ্ণ- বহে সে-ও একই প্রাণ : ভাবসম্প্রসারণ?

কালো-সাদা সবাই স্রষ্টার সৃষ্টি। কালো ও সাদা হওয়ার পেছনে কারও হাত নেই। তা হয় স্রষ্টার ইচ্ছায়। তাই তাদের অবহেলা অপমান করার নির্বোধের কাজ। একটা সময় ছিল, যখন কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হত। তাদের ভোটাধিকার ছিল না, উচ্চ মর্যাদার চাকরি করতে পারত না, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারত না, সাদাদের সাথে একই টেবিলে বসতে পারত না। কিন্তু আধুনিক সমাজে কালো চামড়া মানুষ ও সাদা চামড়ার মানুষ বলে কাউকে বৈষম্য করা হয় না। কৃষ্ণাঙ্গরাও এখন পৃথিবীর শীর্ষ মর্যাদার পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তার উজ্জ্বল উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা, জাতিসংঘের সাবকে মহাসচিব কফি আনান। এছাড়া নেলসন মান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং, মাইকেল জ্যাকসন প্রমুখ কালো হলেও পৃথিবীর উচ্চ মর্যাদার আসন লাভ করেছেন। তাই কালো মানুষদের অবহেলা অপমান করা অযৌক্তিক। তাদের রক্ত, অস্তি-মজ্জা যেরকম, সাদা মানুষেরও ঠিক একইরকম। প্রতিটি মানুষকে যাচাই করা দরকার তার কর্ম দিয়ে। যারা মহৎ কর্ম সম্পাদন করেন, তারা সাদা না কালো সেটা মুখ্য বিষয় নয়। মূলত সাদা এবং কালো প্রত্যেকের শরীরে একই রক্তধারা বয়ে চলেছে। একই প্রাণের ধারা উভয়ের মাঝে বিরাজমান।

শিক্ষা: ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বৈষম্য করা উচিত নয়। প্রতিটি মানুষই স্রষ্টার সৃষ্টি, তাদের অবহেলা অপমান করা-স্রষ্টাকে অপমান করার শামিল।

 

কাক কোকিলের এক বর্ণ, স্বরে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন

কাক ও কোকিল দেখতে একই রকম। উভয়ের গায়ের বর্ণ কালো। কিন্তু পাখি দুটি আমাদের কাছে সমানভাবে সমাদৃত হয় না। কণ্ঠস্বরের কারণে তাদের মান আলাদা। কোকিলের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত সুমধুর। কোকিল তার গানে মানুষের মন আনন্দে ভরিয়ে দেয়। অন্যদিকে কাক মানুষের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় একটি পাখি। কাকের কণ্ঠস্বর খুবই কর্কশ। কাকের ডাকাডাকিতে মানুষ বিরক্ত হয়। অনুরূপভাবে আমাদের সমাজেও অনেক মানুষ দেখা যায় যারা শুধু দৈহিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই মানুষ। তাদের ভেতরটা মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। তাদের মনটা থেকে গেছে পশুর মতো। ত্যাগ, পরোপকার মহত্ত্ব প্রভৃতি মানবীয় গুণাবলীর সাথে তারা পরিচিত নয়। নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করাই এদের মূল উদ্দেশ্য। এরা সমাজ ও জাতির কোনো উপকারেই আসে না। ফলে সমাজের কাছে এদের মান, মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা নেই। সমাজ সবসময় এদের হীন দৃষ্টিতে দেখে। পক্ষান্তরে আমাদের সমাজে এমন মানুষও আছে যাদের অন্তর ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। তাদের দৈহিক বৈশিষ্ট্যকে ছাপিয়ে প্রকাশিত হয় তাদের মনুষ্যত্ব। মানবজাতির বৃহৎ কল্যাণের কাছে তারা জলাঞ্জলি দেয় নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ। লোভ-লালসা তাদের স্পর্শ করতে পারে না। সমাজে এসব মানুষদের স্থান তাই সবার উপরে। মৃত্যুর পরও তারা তাদের কর্মের মধ্য দিয়ে অম্লান থাকে মানুষের মনে।

শিক্ষা: বাহ্যিক চেহারা ও গুণাবলী পরিমাপের মাপকাঠি নয়। মানুষ হিসাবে জন্ম নিলেই প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। উৎকৃষ্ট কর্মের মাধ্যমে ‘মানুষ’ পরিচয় অর্জন করে নিতে হয়।

করিতে পারি না কাজ সদা ভয় সদা লাজ। সংশয়ে সংকল্প সদা টলে পাছে লোকে কিছু বলে


মানুষ জন্ম থেকেই কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে পৃথিবীতে আসে। প্রতিটি মানুষই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ঠের অধিকারী। ভয় ও লজ্জা তেমনি মানুষের দুটি স্বভাবজাত বিষয়। ভয় এবং লজ্জা নেই এমন কোনো মানুষ বিশ্ব সংসারে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই বলে ভয় এবং লজ্জার জন্য নিজের কর্মস্পৃহাকে অবহেলা করা ঠিক নয়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন কর্মময় জীবন-যাপন করার জন্য। মানুষ নিজের কর্মের দ্বারাই জগতে কীর্তিমান হয়। কর্মহীন মানুষ সমাজের অলস এবং অথর্ব হিসেবে পরিচিত। কাজকে যারা ভয় পায় তারা কখনোই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। জগতের কোনো কাজই ছোট নয়। কাজকে যারা ছোট করে দেখে তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। সভ্যতা বিনির্মাণে কর্মঠ মানুষের অবদান অনেক। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর সীমাহীন ধৈর্যের বিনিময়ে সভ্যতার শুভ সূচনা হয়েছিল। আজ সেই সভ্যতা আলোকিত হয়েছে মানুষের কর্মমুখরতার কারণে। কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে যেমন লক্ষ্য স্থির করতে হয়, তেমনি কোনো কাজ বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন দৃঢ় সংকল্প। লক্ষ্য স্থির না করে যেমন কিছু করা যায় না তেমনি, সংকল্প না থাকলে সফল হওয়া যায় না। মানুষের কাজের জন্য যেমন প্রশংসা জোটে তেমনি সমালোচনাও হয়। তাই বলে সমালোচনার ভয়ে কাজ থেকে বিরত হওয়া কিংবা সংকল্প থেকে দূরে সরে আসা ঠিক নয়। বুদ্ধিমান এবং সাহসী মানুষ সর্বদাই ভয় এবং সমালোচনাকে তুচ্ছ করে স্বীয় কাজে কীর্তিমান হয়। জগতের যত বড় বড় অভিযান সফলতার মুখ দেখেছে তার পিছনে ছিল দৃঢ় সংকল্প এবং সাহসী পরিকল্পনা। কর্মে সফল হওয়ার জন্য যেমন জড়তা ঝেড়ে ফেলতে হবে তেমনি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে।

শিক্ষা: ভয় কে জয় না করতে পারলে কর্ম সম্পাদন সম্ভব হয় না। দৃঢ় সংকল্প না থাকলে মানুষের সমালোচনার ঝড় সামাল দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রই কর্মঠ এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়

 

আভিজাত্যের অহংকারের মতো অন্যায়বোধ হয় আর একটিও নাই

অঢেল সম্পদের অধিকারী হলেই প্রকৃত ধনী হওয়া যায় না। প্রকৃত ধনী হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটি উদার মন। আমাদের সমাজে বহু অভিজাত ব্যক্তি আছে যারা সম্পদেও মোহে পড়ে অন্যকে যথাযথ সম্মান দেয় না। এতে তাদের সংকীর্ণ ও অহংকারী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। অহংকার সমাজের চোখে সব সময় একটি গর্হিত অন্যায়। আর আভিজাত্যের অহংকার আরো বড় অন্যায়। কারণ আভিজাত্য মানুষে মানুষে বিবাদ সৃষ্টি করে। একই সমাজে মানুষ পরস্পরের শত্রু হয়ে যায়। সম্পদের অহংকার সমাজে নানা ধরণের শ্রেণিভেদ তৈরি করে। আভিজাত্য মানুষকে অনেক সময় পশুর পর্যায়ে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে তখন মানবিক গুণ বলতে কিছুই থাকে না। যেকোনো উপায়ে তারা তখন সমাজের কর্তৃত্ব দখল করার চেষ্টা করে। আভিজাত্যের অহংকার সামাজিক বন্ধন নষ্ট করে দেয়। তাই নিজের ধন-সম্পদ নিয়ে যারা অহংকারে লিপ্ত থাকে তারা সমাজের বিচারে সবচেয়ে বড় অন্যায়কারী। আভিজাত্যের অহংকার মানুষকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যখন সে অপরের অধিকার সম্পর্কে একটুও চিন্তা করে না। সম্পদের দাম্ভিকতা তাকে সামাজিকভাবে অন্ধ করে দেয়। সে যেন তার চেয়ে কম সম্পদশালীদের দেখতেও পায় না। যারা আভিজাত্যের অহংকার করে তাদের কাছে অন্যের অধিকারের কোনো মূল্য থাকে না। অথচ সমাজ চায় ধনী গরীব সবাই একই কাতারে থাকুক। মানবিক মূল্যবোধের চেয়ে সম্পদের মোহ অনেক বড় হয়ে যায় বলে আভিজাত্যের অহংকারী সমাজের চোখে একজন ঘৃণ্য ব্যক্তি। সাময়িক আভিজাত্য নিয়ে অহংকার করা সমাজের সবচেয়ে গর্হিত অন্যায় বলে বিবেচনা করা হয়।

শিক্ষা: ধনসম্পদের আভিজাত্য একজন মানুষের আসল পরিচয় বহন করে না। আভিজাত্যের অহংকার মানুষকে নিশ্চিত পতনের দিকে ঠেলে দেয়।

 

আপনারে কভু ভেবোনা ক্ষুদ্র, ভাবিওনা দীন তুমি তুমি নিতে পার জয় করিয়া এ বিপুল বিশ্বভূমি

পৃথিবীতে সব মানুষেরই মর্যাদা সমান। সামাজিক স্তর বিন্যাসের দিক থেকে ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু, ব্রাহ্মণ, শুদ্র ইত্যাদি ভাগ রয়েছে। তবে প্রতটি মানুষের মর্যাদা তার অবস্থানে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি সকল মানুষের মর্যাদা সমান। মানুষকে ক্ষুদ্র ও দীন-ভাবার কোনো সুযোগ নেই। সমাজ পরিচালনায় সকল মানুষের প্রয়োজন পড়ে। আমাদের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনার জন্য কামার, কুমার, তাঁতী, জেলে, মেথর, মুচি, দিনমজুর সবারই প্রয়োজন আছে। কাউকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আজ যদি মেথর সম্প্রদায় তাদের কাজ করা বন্ধ করে দেয় তাহলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে। সামাজিক স্তর বিন্যাসে যারা নিম্ন, তাদের নিজেদের ছোট ভাবার কোনো কারণ নেই। সবার মাঝেই সুপ্ত প্রতিভা আছে। সে সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত করতে হবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন অতি সাধারণ লোক ছিলেন। তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে, একজন সাধারণ লোক হয়েও এ বিশ্বজগতকে জয় করা যায়। নিজেকে ক্ষুদ্র না ভেবে, সৃষ্টিশীল কাজে মগ্ন থাকতে হবে। নিজ অবস্থান থেকে যতটা সম্ভব আর্ত-মানবতার জন্য কাজ করতে হবে। পৃথিবীতে সবাই সমান মেধা নিয়ে জন্মায় না। মেধাকে কাজে লাগাতে হবে। পৃথিবীকে জয় করতে হলে কাজের বিকল্প নেই। এ পৃথিবীতে অনেক দরিদ্র ঘরেও অনেক শ্রেষ্ঠ মানুষের জন্ম হয়েছে। তাই যেকোনো সমাজেই মানুষ জন্মগ্রহণ করুক না কেন, তার নিজেকে ছোট ভাবা উচিত নয়। বরং আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে সৃষ্টিশীল কাজ করতে হবে। যে সৃষ্টিশীল কাজ করতে পারবে, সে তত তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে তার একটা অবস্থান তৈরি করতে পারবে। এ পৃথিবী উঁচু-নিচু সমাজের স্তরভেদ চেনে না। চেনে মানুষের কর্মকে। তাই যেকোনো ব্যক্তিরই এ বিপুল বিশ্বভূমি জয় করার অধিকার আছে।

শিক্ষা: শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব গুণ দুটি নির্দিষ্ট কোনো সমাজের নয়। কর্মের মাধ্যমে এ গুণ অর্জন করতে হয়। আর তা সবার জন্য উন্মুক্ত।

 

আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে।

উপদেশ দেওয়ার মানুষের অভাব হয় না। আমাদের সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা উপদেশ দিতে খুবই পছন্দ করেন। কিন্তু তাদের নিজেদের জীবনে সে কাজের প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায় না। এমন ব্যক্তিরা যখন কাউকে কোনো কিছু শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেন, তখন সেটা খুব কমই গ্রহণযোগ্য হয়। ভালো কাজ করতে বলা খুবই সহজ, কিন্তু ভালো কাজ করে দেখানোটা খুবই কঠিন। মানবজাতির ধর্মই হলো অন্ধকার ও নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ। এইসব খারাপ কাজে মানুষ সহজাত প্রবৃত্তিগত কারণেই আকৃষ্ট হয়। এসব থেকে দূরে থেকে জীবনে সুন্দর ও সত্যের বিকাশ ঘটানোই প্রতিটি মানুষের করণীয়। কিন্তু এসব মিথ্যা ও অন্ধকারের হাতছানিকে উপেক্ষা করে জীবনে সততার পথ অবলম্বন করা ভীষণ কঠিন। আর এই কঠিন কাজটি নিজেরা সম্পাদন করার পরই কেবল অন্যদেরকে শিক্ষা দেওয়া উচিত। তবেই সেই শিক্ষা অর্থঃ বহ হয়ে উঠবে। একজন নীতিবান মানুষ তার সারাজীবনে ন্যায়, নীতি ও অনুশীলন করলেই কেবল অন্যরা তার নিকট থেকে উপদেশ গ্রহন করবে। মহানবী (স.) এর নিকট একদা এক মা এসে তার ছেলেকে মিষ্টি খেতে নিষেধ করার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি সেই মাকে এক সপ্তাহ পরে আসতে বলেন। সেই এক সপ্তাহে তিনি আগে মিষ্টি খাওয়া পরিহার করেন, তারপর সেই ছোট ছেলেটিকে মিষ্টি খেতে নিষেধ করেন। এই উদাহরণ আরো স্পষ্ট করে যে, নিজে না করে, অন্যকে কিছু করতে বলাটাই অন্যায়। শুধু ইসলাম ধর্মেই নয়, অন্যান্য সকল ধর্মেই একই কথা বলা হয়েছে। গুণীজনদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও আমরা তাদের চরিত্রে এই গুণেরই চর্চা দেখতে পাই। সুতরাং উপদেশ দেয়ার আগে আমাদের অবশ্যই চিন্তা করতে হবে আমরা নিজেরা কাজটি করতে কতটুকু সক্ষম।


শিক্ষা: যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে উপদেশ প্রদানের পূর্বশর্ত হলো নিজে সেই কাজের যথার্থ অনুশীলন করা। নিজে সে কাজ করে দেখাতে না পারলে উপদেশ অর্থঃ হীন হয়ে পড়ে। নিজে করে অপরকে শিক্ষা দিলেই, কেবলমাত্র সেই শিক্ষা গ্রহণযোগ্য হয়।

আছে যাহা আপন হাতে, নিত্য খুশি থাকো তাতে পরদ্রব্যে করলে আশা, দুঃখ পাবে সর্বনাশা।

মানুষ বাঁচার প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মৌলিক চাহিদার সম্মুখীন হয়। অর্থঃ নীতির ভাষায়- ‘মানুষের অভাব অসীম কিন্তু সম্পদ সীমিত’। সুতরাং, মানুষকে নিজের যা কিছু আছে তা দিয়েই অসীম অভাব পূরণের চেষ্টা করতে হবে। অভাববোধ থেকেই মানুষের মধ্যে চাওয়ার প্রবণতা জন্ম নেয়। তবে আকাক্সক্ষা ও প্রাপ্তির একটা সীমা থাকা দরকার। চাওয়ার প্রবণতা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলেই জীবনে বিপদ নেমে আসে। অল্পতেই মানুষকে তুষ্ট থাকা উচিত। নিজের যা কিছু আছে তাতেই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। অভাববোধকে যদি কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তখনই সংকটের সৃষ্টি হয়। তখন অতৃপ্ত জীবনকে পরিপূর্ণতা দানের জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে। ক্রমেই সে অন্যায় পথে পা বাড়ায়, অপরের ক্ষতি করে এবং নিজেকে সমাজের চোখে ছোট করে। লোভে পতিত হলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে লিও টলস্টয়ের গল্পের নায়ককে আদর্শ উদাহরণ বলা যায়। সূর্যাস্ত পর্যন্ত যতটুকু যেতে পারবে ততোটুকু জমির স্বত্ত্বাধিকারী করার কথা তাকে বলা হয়েছিল। পথ চলতে চলতে সে একসময় ক্লান্ত হয়ে যায়। কিন্তু আরও পাওয়ার লোভে আসক্ত হয়ে আবার হাটতে শুরু করে। এক সময় তার জীর্ণশীর্ণ শরীর মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। এতে বোঝা যায়, লোভে সম্মোহিত হয়ে মানুষ নিজেরই ধ্বংস ডেকে আনে। কথায় আছে ‘লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু’। যারা অল্পে তুষ্ট তারা ন্যায়নিষ্ঠা ও সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে। যারা নিজেদেরকে ভোগের তাড়নার ঊর্ধ্বে রাখতে পারে তারা নিজেদের জীবনে এবং অপরের জীবনেও মঙ্গল বয়ে আনতে পারে। আর যারা নিজেদের অল্প সম্পদে তুষ্ট না থেকে লোভে পড়ে অন্যের সম্পদ আশা করে তাদের ধ্বংস অনিবার্য।

শিক্ষা: সন্তুষ্টি এবং তৃপ্তিবোধই আমাদেরকে সুন্দর ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে। নিজের সম্পদে তুষ্ট থাকাতেই প্রকৃত সুখ নিহিত। অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ করলে চরম দুঃখে নিপতিত হতে হয়।

 

আগে চুরি করে জেল খাটে পরে, নির্বোধ চোর তারা আগে জেল খাটে পরে চুরি করে, সেয়ানা স্বদেশী তারা। ,

জ্ঞান-বুদ্ধির সদ্ব্যবহার করলে হয় জনকল্যাণ আর এর অপব্যবহার করলে হয় সমাজের ভয়ংকর ক্ষতি। আর এই অপব্যবহারকারীরা হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু। তারা অসৎ ব্যক্তি উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য নিজেদেরকে রাজনীতি নামক মোড়কের আড়ালে ঢেকে সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে থাকে। দেশপ্রেমিক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য দু’চারটি প্রহসনমূলক ভালো কাজ করে জনমনকে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে শুরু হয় তাদের পথচলা। তাদের স্বাভাবিক চেহারা দেখে মুখোশের আড়ালে লুকায়িত নির্লজ্জ চেহারা চেনা যায় না। কারণ তারা অত্যন্ত ধূর্ত ও কপট। তাদের মুখে সবমসয় লেগে থাকে কৃত্রিম হাসি, যা দিয়ে তারা যেকোনো মানুষকে অতি সহজেই বিভ্রান্ত করতে পারে। জনগণের সহানুভূতিই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। আর সে লক্ষ্য হাছিলের জন্য তাদের রয়েছে অভিনব সব পদ্ধতি। সেই পদ্ধতিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো জেলে যাওয়া। তাদের আচরণ দেখে মনে হবে তারা যেন ওখানে যেতেই সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এলোমেলো রাজনৈতিক চিন্তাধারা, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি, মূল্যবোধের চরম ধ্বংস, তাবেদারি সংস্কৃতির কারণে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে কখনো কখনো এ রকম অনেক কপট নেতা জনতার উৎকর্ষের রথচক্রকে খানাখন্দেও ফেলে দিয়েছে। যুগে যুগে অনেক ধূর্ত নেতৃত্বাভিলাষী কপটতার জাল বিস্তার করে জনতাকে বিভ্রান্তির পথে নিয়ে গেছে। তাদের খপ্পর থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। জাতীয়তাবাবোধ এবং সুনাগরিকের গুণাবলী যেমন, ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক-চেতনাবোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎ জীবন-যাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্যতা, অধ্যবসায়ে বিকশিত সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে সততার সাথে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে হবে।

শিক্ষা: ধূর্ত ব্যক্তিরা ছলে-বলে-কৌশলে প্রতিনিয়তই আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। তাদের সংস্পর্শ থেকে আমাদের নিরাপদে অবস্থান করতে হবে।

আগে চল, আগে চল ভাই পড়ে থাকা পিছে, মরে থাকা মিছে, বেঁচে মরে কিবা ফল, ভাই।


মানুষ মরণশীল। জন্ম-মৃত্যুর কথা ভেবে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। প্রতিটি মানুষকে তার লক্ষ্য স্থির করতে হয়। আর লক্ষ্যকে সামনে রেখেই মানুষকে এগিয়ে যেতে হয়। সমাজে কিছু লোক আছে যারা কাজ পছন্দ করে না। তারা অলসভাবে সময় নষ্ট করে। এতে তাদের মন-মানসিকতা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। তাদের মনে নানা কুসংস্কার এসে ভর করে। অলসতার কারণে তাদের জীবন স্থবির হয়ে পড়ে। তাদের মেধার বিকাশ ঘটে না। উদ্দেশ্যহীনভাবে লক্ষ্য ছাড়া বেঁচে থাকা মানে মৃত্যুর সমতুল্য। এতে মানুষ তার কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলে। তারা মরার আগে বার বার মরে। এ প্রসঙ্গে উহলিয়াম শেকস্পিয়র বলেছেন- “প্রকৃত বীর একবারই মরে, আর কাপুরুষেরা মরে বারবার।” নদীতে যখন স্রোত থাকে না তখন তাতে শৈবাল এসে জন্ম নেয়। এতে করে নদীর গতিপথ থেমে যায়। এমনিভাবে যারা সমাজের পিছনে পড়ে থাকে তাদের জীবনের গতিও থেমে যায়। বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে সাহস নিয়ে বাঁচতে হবে। নানা বাঁধা বিপত্তিকে তুচ্ছ মনে করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। গতিতেই জীবন-স্থিতিতেই মৃত্যু। মানুষ যদি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায় তবে পরিশ্রমের মাধ্যমে তা সম্ভব। পৃথিবী হলো প্রতিযোগিতার স্থান। সংগ্রাম করেই এখানে টিকে থাকতে হয়। পৃথিবীর যে জাতি যত বেশি উন্নত সে জাতি তত বেশি পরিশ্রমী ও গতিশীল। তারা কখনও থেমে থাকে না। চীন, জাপান, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ শ্রমের সঠিক ব্যবহার ও ক্রিয়াশীলতার জন্য বিশ্বের উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। কিন্তু এর জনসংখ্যা বিশাল। আমরা যদি এই বিশাল জনসংখ্যাকে কর্মমুখী করতে পারি তাহলেই আমাদের দেশের উন্নয়ন সম্ভব। কর্মময় গতিশীল জীবনই প্রগতি, কল্যাণ ও উন্নতির নিশ্চয়তা দেয়। আর এ জন্য আমাদের পেছনে পড়ে থাকলে চলবে না। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

শিক্ষা: বড় হওয়ার ইচ্ছা থাকলে কোনো প্রতিকূল পরিবেশ তাকে থামাতে পারবে না। তাই আমাদের সমাজের পেছনে পড়ে থেকে কোনো লাভ নেই। বুকে সাহস নিয়ে জীবন পরিচালনা করতে হবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

 

অহংকার এমন এক আবরণ, যা মানুষের সকল মহত্ত্ব আবৃত করে ফেলে।

 ,

মানুষের সকল মানবীয় গুণের সমনি¦ত বহিঃপ্রকাশই হলো মহত্ত্ব। এসব মানবীয় গুণাবলি দিয়েই মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে নিজেকে আলাদা করেছে, হয়েছে সৃষ্টির সেরা জীব। মহৎ মানুষরা আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে, দেশ ও দশের কল্যাণে আত্মোৎসর্গ করেন। তাঁরা সকল প্রকার হীনতা, দীনতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা ও অহংকার থেকে মুক্ত থাকে। তাঁরা সব সময় দেশ, জাতি ও সমাজকে নিয়ে চিন্তা করেন, নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যান। তাঁরা আলোকিত হৃদয়ের অধিকারী, যে আলোয় জাতি পথ খুঁজে পায়। হাজী মুহাম্মদ মহসীন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, বেগম রোকেয়া প্রমুখ মনীষীগণ মহত্ত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। মহৎ মানুষরা সব সময় চিন্তা করেন কিভাবে মানুষকে প্রকৃত মানুষ করা যায়। তাঁরা বিনয়ের ধারক ও বাহক। কখনোই তারা নিজের ধন দৌলত, বিদ্যা-বুদ্ধি নিয়ে অহংকার করেন না। এটি মানুষকে সদুপদেশ গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে। অহংকারী ব্যক্তি নিজের টাকা, যশ, খ্যাতি, জ্ঞান নিয়ে এতটাই গর্বিত হোন যে মানুষ হয়েও তার মাটিতে আর পা পড়ে না। সে যত বড় পন্ডিত, জ্ঞানী-গুণী, ধনী-দাতা, বীর হোক না কেন, তাকে সমাজের কেউ ভালোবাসে না। বরং মানুষ একজন অহংকারীকে অনেক বেশি ঘৃণা করে। অহংকার মানুষকে ধ্বংসাত্মক কাজেও লিপ্ত হতে প্ররোচিত করে। সেই সাথে কালের পরিক্রমায় অহংকার দরিদ্রতাও ডেকে আনে। ফলে অহংকারের আবরণে ব্যক্তির সব মহত্ত্ব ঢাকা পড়ে যায়। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলেন- ‘তুমি পর্বততুল্য উচ্চ হইলে গর্ব দোষে খর্ব হইবে, ইহা বিচিত্র নহে।’

শিক্ষা: অহংকার পরিত্যাগের মাধ্যমেই মানুষের মহত্ত্ব বিকশিত হয়। অহংকার ও দাম্ভিকতা জগতশ্রেষ্ঠ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাঁধা। মানব চরিত্রের এই নেতিবাচক গুণটি সর্বদাই পরিত্যাজ্য।

অসির চেয়ে মসি বড়।

 ,

‘অসি’ অর্থঃ াৎ তরবারি ক্ষমতার প্রতীক। আর ‘মসি’ অর্থঃ াৎ লেখার জন্য ব্যবহৃত কালি জ্ঞানের প্রতীক। ক্ষমতালিপ্সু মানুষরা অসির বলে অনেক প্রাণ বিনষ্ট করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করে। কিন্তু অল্পদিনই তারা নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখতে পারে। কিছুদিনের মধ্যেই আবার সেই স্থান দখল করে নেয় অন্য কোনো ক্ষমতাপিপাসু মানুষ। এমন অনেক দৃষ্টান্ত আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই। পক্ষান্তরে মনীষীগণ মসির সাহায্যে মানবজাতির কল্যাণে অনেক সৃষ্টিশীল কর্ম লিপিবদ্ধ করে যান। যা যুগে যুগে মানুষকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ দেখায়। তাঁদের লিপিবদ্ধ চিন্তাধারা সভ্যতাকে নিয়ে যায় উৎকর্ষের পথে। আর এই উৎকর্ষের পথ ধরেই মনীষীগণ সম্মান পান মানুষের অন্তরে। অন্য কেউ তাঁদের সম্মানটি দখল করতে পারে না। এমনকি মৃত্যুর পরও তাঁরা অমলিন হয়ে থাকেন মানব সভ্যতার ইতিহাসে। কিন্তু যারা অসির বলে বলীয়ান মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে যায় মহাকালের স্রোতে। অসি আর মসির মধ্যে যুদ্ধে মসি হেরে যাবে। কিন্তু অসির এ জয় ক্ষণিকের। শাশ্বত ন্যায় যুদ্ধে মসিই বিজয়ী। অসির ক্ষমতা ধূমকেতুর ন্যায়। এর স্থায়িত্ব খুবই কম সময়ের জন্য। কিন্তু মসির ক্ষমতা সূর্যের ন্যায়। সূর্য যেমন সৃষ্টির আদি থেকে প্রতিদিন তার নিয়মেই আলো ছড়াচ্ছে, মসিও তেমনি অনন্তকাল ধরে নীরবে মানুষকে সত্য, সুন্দর ও শান্তির পথ দেখাচ্ছে।

শিক্ষা: অসি তার ধ্বংসলীলার মধ্য দিয়ে মানবজাতিকে দুঃখের সাগরে ভাসায়। আর মসি তার ফোঁটায় ফোঁটায় গড়ে তোলে স্বপ্ন, সভ্যতাকে নিয়ে যায় সমৃদ্ধির পথে। তাই মসিই হওয়া উচিত আমাদের জীবনে চলার পথের পাথেয়।

 

অভাবে স্বভাব নষ্ট। ,

পৃথিবীতে চাহিদার তুলনায় সম্পদের পরিমাণ কম বলেই অভাবের তীব্রতা এত প্রকট। সীমিত সম্পদের কারণে অসীম অভাবের অপূর্ণতা মানুষের মনুষ্যত্ব ও স্বভাবের উপর প্রভাব বিস্তার করে। অভাব বলতে শুধু অর্থঃ াভাব নয়, বরং জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ এর অভাবকেও বোঝায়। যার মধ্যে মূলত অর্থঃ াভাবই প্রধান। মানুষ অর্থঃ াভাবে পড়লে স্বাভাবিক বোধশক্তি কমে যায়, তখন তাদের নেওয়া সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে। প্রায় ক্ষেত্রেই অভাবের তাড়নায় খারাপ সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়। ঋণমুক্তির জন্য অনেক সময় অতিরিক্ত ঋণ করার প্রবণতাও দেখা যায়, যাতে দুর্দশা আরও বাড়ে। দরিদ্র অবস্থায় অর্থঃ ছাড়াও আরও কিছু বিষয় লক্ষ্য করা যায়। এ সময় বুদ্ধিবৃত্তিও কমে যায়। গরিব বলে কম মেধা রয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। বরং আর্থিক দুশ্চিন্তার সঙ্গে বিষয়টি সম্পর্কিত। পরিমিত অভাব মানুষকে সুখের স্বাদ পেতে সাহায্য করে। অভাব মিটানোর প্রয়োজনে মানুষ অনেক কিছু আবিষ্কার করতেও সক্ষম হয়েছে। অভাবের সুযোগ নিয়ে প্রতারকেরা প্রতারণার ফাঁদ পেতে রাখে সর্বত্র। মানুষ যেমনি অভাবের তাড়নায় ঘৃণিত পথে পা বাড়ায়। তেমনি সমাজে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থার কারণে কিছু বিলাসী মানুষের অপ্রয়োজনীয় বিত্তপ্রদর্শন অভাবী মানুষের মাঝে লোভ-লালসা ও হতাশার সৃষ্টি করে। যা থেকে সমাজে চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, মারামারি এমনকি খুন-খারাবি পর্যন্ত হয়ে থাকে। অভাবের সময় ধৈর্যধারণ করে ক্রমাগত চেষ্টা করার মধ্যেই সফলতা রয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের অন্য কোনো পথ নেই। তাইতো মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।’

শিক্ষা: যখন মনুষ্যত্ব জেগে ওঠে তখন অভাব আর স্বভাবের সম্পর্ক একরৈখিক থাকে না। অভাবের সময় ধৈর্যধারণ করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছু নেই, ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে ধ্বংস অনিবার্য।

অপরের দুঃখ কথা করিলে চিন্তন আপনার মনে দুঃখ থাকে কতক্ষণ। ,

সম্প্রসারিত ভাব পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ বাস করে আর তাদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা দুঃখ-কষ্ট, অভাববোধ আছে। তবে সে দুঃখ-কষ্টগুলো একান্তই ব্যক্তিগত। আর কেবলমাত্র ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের চিন্তা করা কোনো মানুষের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। কেননা শুধুমাত্র নিজের ভোগ-বিলাস আর স্বার্থরক্ষার জন্য মানবজীবন নয়। মানুষ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে সমাজবদ্ধভাবে বাস করে। এই সমাজবদ্ধ জীবনে স্বার্থপরের মতো শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত নয়। বরং চারপাশের সমস্ত দুঃখী, অভাবী মানুষের দুঃখকে উপলব্ধি করতে হবে। অন্যের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই প্রকৃত সুখ নিহিত। অন্যের দুঃখ-কষ্টকে নিজের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করতে পারলে নিজের দুঃখগুলো ভুলে থাকা যায়। যে ব্যক্তির পা নেই তার কথা চিন্তা করলে নিজের জুতা না থাকার অভাব বা কষ্ট নিতান্তই নগন্য মনে হয়। মহৎপ্রাণ ব্যক্তিগণ নিজেদের দুঃখ, বেদনা, হতাশা, ব্যর্থতাকে ভুলে অপরের কল্যাণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। অপরের কল্যাণে নিজেদের স্বার্থ চিন্তা পরিহার করেছেন বলেই তাদের জীবন হয়েছে মহান। ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়েছে তাদের মহৎ ত্যাগের কথা। মানুষ কেবল নিজের জন্য জন্মগ্রহণ করেনি। শুধুমাত্র নিজের ভোগবিলাস, পাওয়া না পাওয়ার হিসেবে ব্যস্ত থাকলে সেই মানুষ কোনোদিনও জীবনের প্রকৃত সুখের সন্ধান পায় না। অন্যদিকে, নিজের দুঃখ-কষ্টকে বড় করে না দেখে যে ব্যক্তি অন্যের দুঃখ- বেদনাকে উপলব্ধি করতে পারে এবং সে দুঃখ লাঘবে সহায়তা করে সেই প্রকৃত সুখী। যে সত্যিকারের মানুষ সে অপরের দুঃখে ব্যথিত হয় এবং অন্যের দুঃখ দূর করতে নিজের সুখ বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করে না। অপরের দুঃখ-কষ্টকে উপলব্ধি করে সে নিজেদের দুঃখের কথা ভুলে যায়। জীবনের সত্যিকার সুখের দেখা পায় সে, যে অপরের দুঃখ-বেদনার কথা ভেবে ব্যক্তিগত দুঃখকে মনে স্থান দেয় না।

শিক্ষা: স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে এই মহৎ জীবনকে সার্থক করতে হলে, কেবল নিজের স্বার্থচিন্তা না করে, অন্যের দুঃখ-বেদনাকে উপলব্ধি করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, অপরের দুঃখ-বেদনা ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই মানব জীবনের সত্যিকারের সুখ নিহিত।

 

সুষ্ঠু শিক্ষানীতি জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি 

মূলভাব : শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। জাতির অগ্রগতি ও উন্নতি নির্ভর করে সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থার উপর। আমাদের দেশে শিক্ষার হার খুব বেশি নয়। শিক্ষা যেখানে জাতীয় উন্নতির পূর্বশর্ত সেখানে এ নগণ্য শিক্ষার হার আমাদের ভবিষ্যতকে অনুজ্জ্বল করে ফেলেছে। তা ছাড়া দেশে বর্তমানে শিক্ষার উত্তম পরিবেশ বজায় নেই। দেশের শিক্ষার মান বাড়িয়ে দেশকে সমৃদ্ধিশালী করতে হলে, আমাদের প্রয়োজন একটি সুষ্ঠু শিক্ষানীতি। 

সম্প্রসারিত ভাব : নানা সমস্যা আমাদের শিক্ষা জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। সেশন জট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থান সংকুলানের অভাব, পরীক্ষায় ব্যাপক দুর্নীতি, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, শিক্ষার্থীর অস্পষ্ট ভবিষ্যৎ ইত্যাদি কারণে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এক নৈরাশ্যজনক অবস্থায় পতিত হয়েছে। এ নৈরাজ্যজনক অবস্থায় ছাত্র সমাজের অবস্থান খুবই নাজুক। অথচ দেশগড়ার ক্ষেত্রে এ ছাত্র সমাজের সবচেয়ে বড় অবদান রাখার কথা। সুষ্ঠু শিক্ষানীতির অভাবে শিক্ষার যথাযথ উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। সুষ্ঠু শিক্ষানীতির মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়নের জন্য যে সমস্ত নীতি নির্ধারণ করা যায় তা দিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। যে দেশের সুষ্ঠু শিক্ষানীতি নেই সেই দেশের কাছে শিক্ষার কোন সুষ্ঠু অবকাঠামো আশা করা যায় না। একটি শিক্ষানীতির মাধ্যমেই শুধু শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও বাস্তবমুখী করা যায়। বর্তমানে পরীক্ষায় যে ব্যাপক দুর্নীতি চলছে তার সঠিক সমাধান দিতে পারে একটি সুষ্ঠু শিক্ষানীতি। শিক্ষানীতি হচ্ছে সেসব নিয়মকানুন যা একটি দেশের শিক্ষার মৌলিকত্ব তুলে ধরে। শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব বাধা থাকে শিক্ষানীতি সর্বপ্রথম সেসব বাধাগুলোকে চিহ্নিত করে। অতঃপর সেই বাধাগুলো আপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ করে। প্রাথমিক শিক্ষা হতে শুরু করে উচ্চশিক্ষারও আমূল পরিবর্তন ঘটানো যায় সুষ্ঠু শিক্ষানীতির মাধ্যমে। শিক্ষানীতি শুধু শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করে না, শিক্ষকদেরও সমস্যা সমাধানের পন্থা নির্ধারণ করে। আমাদের জাতীয় উন্নয়ন তখনি সম্ভব যখন আমরা সুশিক্ষিত হতে পারবো এবং শিক্ষাকে প্রয়োজনীয় উপকরণের মত ব্যবহার করতে পারবো। মোট কথা জাতীয় উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে শিক্ষার মৌলিক উন্নয়ন আর শিক্ষার উন্নয়ন করতে গেলে যেটা আমাদের অবশ্যই পালন করতে হবে তা হল দেশের জন্য সুষ্ঠু শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। সুষ্ঠু শিক্ষানীতির অভাবে শিক্ষা তার স্বাভাবিকতা খুঁজে পাবে না। 

আর এর ফলে দেশের জাতীয় উন্নয়ন কখনওই সম্ভব নয়। যখন একটি সুন্দর, সুষ্ঠু শিক্ষানীতি প্রণীত হবে ঠিক তখনি দেশের জাতীয় উন্নয়নের প্রসারতা লাভ করবে।

হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনে

কাজ করে যাও গোপনে গোপনে,

মুখর দিনের চপলতা মাঝে স্থির হয়ে তুমি রও।

মূলভাব : জীবনকে সুন্দরভাবে বিকশিত করতে হলে অতীতের প্রভাব অপরিসীম। কারণ অতীত হচ্ছে বর্তমানের সিঁড়ি এবং অনাগত ভবিষ্যতের পথ প্রদর্শক।

সম্প্রসারিত ভাব : বর্তমান দাঁড়িয়ে আছে অতীত ভিত্তির ওপর। আর সুন্দর বর্তমানের ওপরেই গড়ে ওঠে সাফল্যময় ভবিষ্যৎ। কাজেই বলা যায়, গৌরবময় অতীত জন্ম দেয় সুখী-সমৃদ্ধ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। অতীতের প্রভাবকে কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। পৃথিবীতে যে জাতি যত সভ্য ও উন্নত সে জাতি তার অতীত সম্পর্কে তত বেশি সচেতন। প্রত্যেক জাতিই তাদের অতীতের ঐতিহ্য ও গৌরবকে সবার সামনে তুলে ধরে এবং এ দিয়ে রচনা করে অমর গাঁথা। গৌরবময় সোনালি অতীত জাতিকে চেতনায় উজ্জীবিত করে। কোনো জাতির বর্তমান সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশের পথে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে সে জাতির ঐতিহ্যময় অতীত। জাতি যখন দিক ভ্রান্ত হয়, দিক নির্দেশনার অভাবে যখন হারিয়ে যেতে থাকে জটিল আবর্তে, তখন অতীতই প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের বাঙালি জাতির রয়েছে গৌরবময় অতীত। আবহমান বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতিই আমাদের প্রেরণার উৎস। যখনই আমরা জাতীয় সংকটে নিপতিত হই, তখনই আমাদের ঐতিহ্যময় সোনালি অততি আমাদেরকে চেতনায় উদ্দীপ্ত করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা। আমাদের সংগ্রামময় অতীতের সফল বাস্তবায়ন। অতীত কখনো বিস্মৃত নয়। তাই অতীতকে সবসময় গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করা উচিত।

হাত জোড় করে নয়, হাত মুঠো করেও নয়।

পেতে হলে হাত লাগাতে হবে।

মূলভাব : সফলতাই হলো জীবন। যে জীবনে সফলতার বিদ্যুতের ঝলকানি নেই সে জীবন নিশ্চেষ্ট, নিষ্ক্রিয়, নিষ্প্রাণ। ব্যর্থতার দুর্ভেদ্য আঁধারই তার জীবনের একমাত্র সম্বল। সফলতা চলমান সময়ের পথ নির্বাচন করে। 

সম্প্রসারিত ভাব : সাফল্যই জীবন। সাফল্যই মানবিক অভীপ্সা। নিষ্ক্রিয়, নিশ্চেষ্ট জীবনে নেই সফলতার বিদ্যুৎ ঝলকানি। ব্যর্থতার দুর্ভেদ্য অন্ধকারই তার ভাগ্যের একমাত্র সঞ্চয়। সক্রিয় মানুষ তা মেনে নেয় না। প্রয়োজন হয় সফলতার পথটি নির্ণয় করা। ব্যক্তির সহজাত প্রবৃত্তি, আত্মবল ও মননের সঙ্গে আকাঙ্খিত লক্ষ্যের সংযোগ ঘটানো প্রয়োজন, এ সংযোগ রেখাই সেই পথ। দুস্তর বাধা, দুর্গম দূরত্ব, বিভেদী আবহ সেই পথে নিরন্তর দৃশ্য হতে পারে। এ সব মেনে নিয়েই যেটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় তা হল ব্যক্তির প্রকৃতিগত মানসতা। মানসতাই অভিমুখিতাকে সঠিক পথ নির্বাচন করায়। 

জীবনে মানুষের অনেক কিছু আবশ্যক। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান প্রভৃতি জীবন-যাপনের বিষয়গুলির পাশাপাশি স্বাধীনতা, অধিকার, স্বীকৃতি প্রভৃতি নৈতিক জীবনীয়গুলিও জরুরী। বর্ণ, শ্রেণি, সমাজ ও অর্থ অ-মানবিক নানা বৈষম্য সৃষ্টি করে। দেশের যারা সাধারণ অথচ সংখ্যাগুরু তারা অসাম্যের স্বদেশে শোষণের বঞ্চনার জীবন কাটায়। মানবিক সফলতার জন্য ভাঙতে হয় অসাম্যের অচলায়তন, দিতে হয় স্বাধিকারের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু অর্জনের ক্ষেত্রে প্রার্থনার আনুগত্য লক্ষ্যসিদ্ধি ব্যর্থ করে। আত্মশক্তির অভাব, আশ্রয়, আলস্য, অনুগ্রহ-নির্ভরতা কখনও সাফল্য দিতে পারে না। ‘ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ’। ভিক্ষার দৈন্যে অবিশ্বাসী মানুষ প্রতিবাদের পথ অনুসরণ করে। নিছক শারীরিক আস্ফালনও সিদ্ধির বাধা। কেননা যে-দাবীর সঙ্গে আনুপাতিক শ্রমের যোগ নেই, সে দাবী নিরালম্ব ও শূন্যগর্ভ। সাফল্যের উৎস ঘনিষ্ঠ শ্রমে। ভিক্ষাবৃত্তি নয়, নিরর্থক দাবী নয়, শ্রমশক্তিই সাফল্যের সম্ভাবনাকে পরিণতি দেয়। মানুষের চাওয়ার সঙ্গে পাওয়াকে মেলাতে হলে যোগ্য মানসিকতা গঠনের একান্ত প্রয়োজন। সে-মানসিকতার পরিচয় আগ্রহী কর্ম-সচেতনতায় নিহিত। ব্যক্তি-জীবনের প্রসঙ্গে এ সভ্য জাতীয় জীবনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একটি জাতির আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপায়ণের ক্ষমতা জাতির শ্রম-প্রবণতায় দৃশ্য হয়। ঘৃণ্য পরানুগ্রহ, উদ্ধৃত আস্ফালন জাতির বিকাশের পথ রুদ্ধ করে। চাই তন্নিষ্ট শ্রমমুখিতা। স্বনির্ভরতার আদর্শ মেশানো সক্রিয় সাধনা। শ্রমশক্তিই অর্জনের অঙ্গীকার, সাফল্যের সংকেত। 

মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধরনের চাহিদা থাকে। এ চাহিদা পূরণের জন্য পরিশ্রম অপরিহার্য। পরিশ্রম ছাড়া স্বনির্ভরতা সম্ভব নয়।

বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য অতীত নীরবে- নিভৃতে কাজ করে যায়। অতীতকে ভুলে যাওয়া আমাদের উচিত নয়। যে কোনো অগ্রযাত্রার পিছনে রয়েছে অতীত অভিজ্ঞতার সফল প্রয়োগ।

 

সঙ্গদোষে লোহা ভাসে 

মানুষ যে সমাজের ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করে সে-সমাজে আছে নানা ধরনের লোক- জ্ঞানী-মূর্খ, ভাল-মন্দ, সৎ-অসৎ নানারকম মানুষের সমাবেশ সেখানে। সঙ্গ নির্বাচনে একমাত্র বিবেচনার দিক হল গুণবানের বৈশিষ্ট্য- যার সহায়তায় জীবন হয়ে ওঠে উজ্জ্বল। সেখানে দুর্জন বা চরিত্রহীন ব্যক্তির অনুপ্রবেশের কোন সুযোগ নেই। তাই সমস্ত জীবন ভরে কুসঙ্গ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। 

মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ তার চরিত্র। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘The crown and glory of life is character.’ চরিত্রের গুণেই মানুষ শ্রেষ্ঠ আদর্শের মর্যাদা পায়। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে অপরাপর বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটানো আবশ্যক। তাই কুসঙ্গ নয়, সৎসঙ্গের মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করতে হবে। কুসঙ্গে মানুষ অমানুষ হয়ে ওঠে, তার সদগুণসমূহ নষ্ট হয়ে গিয়ে সে হয় পশুর মতো অধম। মানুষ গুণগতভাবেই সত্যের পূজারি, সুন্দরের অনুসারী। আর অসৎ পথে যাওয়ার মূল কারণ অসৎসঙ্গ। অসৎসঙ্গের মধ্য দিয়েই মানুষের চরিত্র কলুষিত হয়। যেমন- লোহা ওজনে খুব ভারী বলে তা পানিতে ডুবে যায়। কিন্তু এ ভারী লোহা যদি হালকা কাঠ বা অসার কোনো পদার্থের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া যায়, তহলে লোহা ভেসে ওঠে, ডুবে না। মানুষের মধ্যেও অসৎ সঙ্গের সাহচর্যের প্রভাব এভাবেই কার্যকরী হয়। সঙ্গদোষে মানুষ পরিবর্তিত হয়ে যায়। কুসংসর্গ চরিত্রহীনতার অন্যতম কারণ। অথচ চরিত্রের মাধ্যমেই ঘোষিত হয় জীবনের গৌরব। চরিত্র দিয়ে জীবনের যে গৌরবময় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় তা আর কিছুতেই সম্ভব নয় বলে সবার ওপরে চরিত্রের সুমহান মর্যাদা স্বীকৃত। যার পরশে জীবন ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয় এবং যার বদৌলতে মানুষ জনসমাজে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হিসেবে আদৃত হয়, তার মূলে রয়েছে উত্তম চরিত্র। স্পর্শমণির ছোঁয়ায় লোহা যেমন সোনা হয়ে ওঠে তেমনি সৎ চরিত্রের প্রভাবে মানুষের পশুপ্রবৃত্তি ঘুচে যায়, জন্ম নেয় সৎ, সুন্দর ও মহৎ জীবনের আকাঙ্ক্ষা। আবার সঙ্গদোষে মানুষ তার চরিত্রকে হারিয়ে পশুর চেয়েও অধম হয়ে যায়। এ জগতে যত লোকের অধঃপতন হয়েছে অসৎ সংসর্গই এর অন্যতম কারণ। মানুষ সতর্ক থাকলেও কুসংসর্গে পড়ে নিজের অজ্ঞাতে পাপের পথে পরিচালিত হয়। তাই সঙ্গ নির্বাচনে আমাদের সতর্ক হতে হবে। 

 

স্বার্থপরতা মানব জীবনের উন্নতির পথে মূল প্রতিবন্ধক

মূলভাব : মানুষ মানুষের জন্য। সকলের সাথে একাত্ম হয়ে, নিজস্ব পরিমণ্ডল থেকে বেড়িয়ে এসে বৃহত্তর মানব কল্যাণে আত্মনিয়োগই মানব জীবনের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত।

সম্প্রসারিত ভাব : মানুষ সামাজিক জীব। অন্যের সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া সে তার জীবনযাপন করতে পারে না। আর এ কারণেই মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। পরের উপকারে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সে আত্মতুষ্টি লাভ করে। কিন্তু সমাজে এমন এক শ্রেণির মানুষ রয়েছে যারা পরের উপকারের চেয়ে নিজেকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পরের স্বার্থের ব্যাপারে উদাসীন থাকে। স্বার্থপর মানুষ সমাজ থেকে নির্বাসিত, স্বার্থমগ্নতা মনুষ্যত্বের পরিপন্থী। স্বার্থের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ হলে মানুষ অন্যের প্রতি মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার স্বাভাবিক ধর্মও হারিয়ে ফেলে। একজন মানুষ হিসেবে সে তার সামাজিক দায়িত্ব পালন না করে পৃথিবীর জঞ্জাল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। স্বার্থমগ্ন মানুষ নিজের উন্নয়ন সাধন করলেও মানুষের মনে স্থায়ী আসন করে নিতে পারে না। মৃত্যুর সাথে সাথে এ পৃথিবী থেকে তাদের নাম চিরতরে বিলীন হয়ে যায়। এমনকি আপনজনেরাও তাদের নাম স্মরণ করে না। মানবজীবনের উন্নতির জন্য যেখানে সম্মিলিত প্রচেষ্ট আবশ্যক, সেখানে স্বার্থপর ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকে বৃহৎ উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। জগতের মহাপুরুষদের দিকে তাকালে আমরা উপলব্ধি করতে পারি তারা সকলেই নিজেকে নিয়ে না ভেবে বৃহৎ কল্যাণে আত্মনিয়োগ করে স্মরণীয় হয়েছেন। তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আমাদেরকে আত্মনিয়োগ করতে হবে সমাজ উন্নয়নে, পরোপকারের মহান ব্রতে উদ্দীপ্ত করতে হবে মনকে।

সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ 

মূলভাব : সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সান্নিধ্যে আসতে হয়। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির চিন্তা, বিশ্বাস প্রবণতা তার ব্যক্তিত্বে প্রভাব ফেলে। সৎ সঙ্গ তাকে জীবনের পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়, অপরপক্ষে অসৎ সঙ্গ তার সুনাম, সাফল্যকে ধ্বংস করে। 

সম্প্রসারিত ভাব : ব্যক্তি তার মানসিক ও সামাজিক অভাব পূরণ করার জন্য সঙ্গী সাথীদের সাথে চলাফেরা ও উঠা বসা করে। সঙ্গীদের চরিত্র যদি পবিত্র ও সুন্দর হয় তাহলে তাদের সঙ্গই সৎসঙ্গ। এ ধরনের সঙ্গীর আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যক্তির নিজস্ব চরিত্র বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। ব্যক্তির পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের উপর তার নিজের পুরোপুরি দখল সচরাচর থাকে না, সঙ্গ চরিত্র দ্বারা তা অনেকাংশে প্রভাবিত হয়। সৎ সঙ্গের প্রভাবে ব্যক্তির নির্মল চরিত্র নির্মল থাকে এবং তা আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। অধিকন্তু সৎ সঙ্গের প্রভাবে অনেক কলুষিত চরিত্রের ব্যক্তিও অনুকরণ ও অনুসরণের পথ অবলম্বন করে নিজের চরিত্রকে নির্মল ও আকর্ষণীয় করে তোলার সুযোগ পায়। শিশুকাল মানব ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্রের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে। এর কারণ শিশু তার সঙ্গী ও পারিপাশ্বিকতাকে অনুসন্ধিৎসার সাথে অনুকরণ করে। তাই তো শৈশবে যদি শিশুকে সৎসঙ্গের নিশ্চয়তা দেওয়া যায় তাহলে বাকি জীবনের জন্য সে চরিত্র গঠনের এক বিরাট সুযোগ পাবে। অপরপক্ষে, অসৎ সঙ্গের কুফল অত্যন্ত ভয়াবহ। কথায় বলে, ‘সঙ্গদোষে কি না হয়।’ সঙ্গীর চরিত্র যদি হয় অসৎ, নিয়ম বিরুদ্ধ এবং কলুষিত হয় তাহলে তার চরিত্রের মধ্যে এ খারাপ দিকগুলো অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা খুব বেশি। সঙ্গ দোষে একজন সৎ চরিত্রের মানুষ যেমন তিলে তিলে অধঃপতনের দিকে তলিয়ে যেতে পারে, তেমনি একজন অসৎ চরিত্রের ব্যক্তিও দিন দিন সঙ্গদোষের উস্কানি এবং কুপ্রভাবে আরও চরিত্রহীন হয়ে যেতে পারে। একটি ল্যাটিন প্রবাদ এ কথারই সাক্ষ্য বহন করে, ‘তুমি যদি খোঁড়াদের সাথে বসবাস কর, তাহলে তুমিও খোঁড়াতে শিখবে।

নিশ্চয়ই এটা একটা অনিবার্য এবং দুঃখজনক পরিণতি।

সৌজন্যই সংস্কৃতির পরিচয়

মূলভাব : সৌজন্যবোধ একটি জাতির সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে অর্থাৎ ব্যবহারের মাধ্যমে কারো সত্যিকারের পরিচয় পাওয়া যায়।

সম্প্রসারিত ভাব : সৌজন্য হচ্ছে মানুষের আচার ব্যবহার যা অন্যের সংস্পর্শে আসলে ফুটে উঠে। শিক্ষার নির্যাসকে সৌজন্য হিসেবে অভিহিত করা যায়। একজন মানুষ শিক্ষিত নাকি অশিক্ষিত তা বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু যখন তার সাথে কথা বলা হয়, তখন তার ব্যবহার ও আচরণ দেখে বলে দেয়া সম্ভব তার পরিচয়। পুঁথিগত শিক্ষাই শুধু সৌজন্য শিক্ষা দেয় না, মূলত তা শেখার জন্য পরিবার ও জাতির সংস্কৃতি ও প্রজ্ঞা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। বস্তুত পরিবার হচ্ছে সমাজ তথা জাতির একক। তাই পরিবারে যখন কোন বিষয়ের চর্চা হয় তা ক্রমে ক্রমে জাতীয় পর্যায়ে স্থান করে নেয়। পরিবার হচ্ছে সকল শিক্ষার সূতিকাগার। পরিবারের সদস্যের সাথে চলাফেরা করলে তাদের আচার-ব্যবহার থেকে ঐ পরিবার সম্পর্কে যেমন ধারণা পাওয়া যায়, তেমনিভাবে যখন কোন জাতির কোন সদস্যদের সাথে আমরা কথা বলি, এক সাথে চলাফেরা করি, তার সৌজন্য, তার শিষ্টাচার আমাদের বলে দেবে তার সংস্কৃতি, জাতি হিসেবে তারা সভ্য না অসভ্য, শিক্ষিত নাকি অশিক্ষিত। পথ ভুলে যাওয়া একজন পথিক, মরুভূমিতে তৃষ্ণায় ছটফট করতে করতে জ্ঞান হারাল জ্ঞান ফেরার পর সে দেখলো দীর্ঘকায় আলখাল্লা পরিহিত একজন মানুষ তাকে পানি পান করাচ্ছে। লোকটি কথা না বললেও বুঝতে পারলো সে অবশ্যই একজন আফগান কেননা, অতিথিয়েতায় তারা বিশ্ব বিখ্যাত।

সংসারে কিছুই চিরদিনের নয়

মূলভাব : নশ্বর এ পৃথিবীতে কোন কিছুই স্থায়ী থাকে না। এ জগৎ সংসারে কিছুই চিরস্থায়ী নয়।

সম্প্রসারিত ভাব : মহান সৃষ্টিকর্তা এ পৃথিবীতে আমাদের সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য। প্রতিটি মানুষের কাজের হিসাব পরকালে আল্লাহ নিবেন। পৃথিবীতে কৃতকর্ম অনুযায়ী নির্ধারিত হবে তার আবাসস্থান। কিন্তু আমাদের যে একদিন এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে এ সত্যটি আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। সংসারের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আশা আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মানুষ লোভ আর অন্যায়ের আশ্রয় নেয়। প্রভাব আর প্রতিপত্তির অন্ধ মোহে সে তৈরি করে প্রাসাদসম বাড়ি, রাজকীয় গাড়ি আর অন্যকে ফাঁকি দিয়ে গরিবকে ঠকিয়ে গড়ে তোলে বিত্তের পাহাড়। কিন্তু পৃথিবী অবিনশ্বর নয়। মানুষ, তার গাড়ি-বাড়ি, ধন সম্পদ সবকিছু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু তবু কি অবোধ মানুষ বোঝে! পৃথিবী নশ্বর জেনেও তার এতোসব আয়োজন। ভোগ-বিলাসে মত্ত মানুষ ভাবে এসব অর্জন তার চিরকালের। মানুষের এ আত্মস্বার্থ ব্যবস্থা আর নিয়তিকে উপেক্ষা করা দেখে মরমী কবি হাছন রাজা গেয়ে উঠেছিলেন-

‘লোকে বলে ,বলে রে

ঘর-বাড়ি ভালা না আমার

কি ঘরও বানাইমু আমি শূন্যেরই মাজার……’

হাছন রাজার এ আত্মোপলব্ধি আমাদের মনের মাঝে সঞ্চারিত হয় না। যা কিছু আমাদের পরকালে সাহায্য করবে, আমাদের স্থায়ী জীবন সুখের না দুঃখের হবে তা নির্ধারণ করবে সে সৎ, সুন্দর ও পুণ্যের পথের অনুসারী না হয়ে মানুষ দুনিয়ার অর্জিত সুখকে বেছে নিচ্ছে। কিন্তু ভবের হাটের দোকান একদিন ভেঙ্গে যাবে তা মানুষ বুঝে না। তারা হীরা ফেলে শুধু কাঁচের দিকেই ছুটছে।

সংসার জীবন সাময়িক, এর মায়ায় পড়ে অনন্ত ভবিষ্যৎকে আমরা তুচ্ছজ্ঞান করছি, আপত লাভকে জীবন থেকে পাথেয় করছি।

 

শক্তি যার নাই নিজে বড়ো হইবারে

বড়োকে করিতে ছোটো তাই সে কি পারে?

মূলভাব : বিনয় বা নম্রতা মানব জীবনকে মহিমান্বিত করে তোলে। সকল মানুষের উচিত নিজের সামর্থ্য, যোগ্যতা নিয়ে তুষ্ট থাকা। অপরের ভালো কিছু দেখে ঈর্ষান্বিত হলে মানব জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। সে না পারে ভালো কিছু করতে না পারে সুখী হতে। তাই আমাদের বিধাতা যা কিছু আমাদের দিয়েছেন সেটা নিয়ে তুষ্ট থাকতে হবে। 

সম্প্রসারিত ভাব : মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ সকল মানুষকে অতি সুন্দরভাবে সৃষ্টি করেছেন। তবে এ মানুষের মাঝে কিছু পার্থক্য আছে। মহৎ ও দুষ্ট সকল প্রকৃতির মিশ্রস্থল হল এ জগৎ। তাই এ জগতে দেখা যায় সমাজে এমন মানুষ আছে যারা নিজের অবস্থানে তুষ্ট নয়। বিধাতা তাকে যা দান করেছে সেটাতে সে খুশি নয়। সে চায় বড় হতে। মানুষের সকল ইচ্ছা পূরণ হওয়ার নয়। ইচ্ছা পূরণের সামর্থ্য না থাকলে ইচ্ছা পূরণ সম্ভবপর নয়। তাই আমরা সমাজে দেখতে পাই একশ্রেণীর মানুষ আছে যারা ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখে। সমাজের বিত্তবান, ধনবান ও জ্ঞানীদের দেখে তাদের মনে লোভের সঞ্চার হয়। আর সে চায় তাদের উপরে উঠতে। এজন্য সে অনুপাতে সে কাজ করে না বরং তাদেরকে আক্রমণ করে। কিন্তু এতে সে আরো ঘৃণ্য জীবে পরিণত হয়, অপরদিকে যাদেরকে আঘাত করা হয় তারা আরো উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়। নিজের সামর্থ্য বা যোগ্যতা না থাকলে শুধু আকাশকুসুম কল্পণা করলে বড় হওয়া যায় না। বড় হওয়ার জন্য মূলত কাজ করতে হয়। সৃষ্টির উপর মানুষের কোন হাত নেই। যদি কেউ নিচ কুলে জন্মগ্রহণ করে তাহলে তার কর্ম যে নিচু হবে এমন হয় না। অর্থাৎ, বেশি আড়ম্বর না করে আমাদের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। নিজের শক্তি, সামর্থ্য কিংবা যোগ্যতা নেই, অথচ সে যদি বড় হতে চায় তাহলে তার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়। মানুষের আকাঙ্ক্ষা থাকে তাহলে সেটা পুষ্পিত হতে পারে। পক্ষান্তরে যদি মিথ্যা বাড়াবাড়ি করে নিজেকে বড় বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সেটা কখনওই সম্ভবপর নয়। 

মানুষ সামাজিক জীব। তার ভেতর ইচ্ছা, বাসনা, ক্রোধ, ঘৃণা সবকিছুই মিশ্রণ ঘটাতে হবে। শুধু বড় হওয়ার স্বপ্ন হৃদয়ে লালন করলে চলবে না। ছোট ছোট মহৎ কর্ম করলে সেটা তাকে একদিন সেই বন্দরের দ্বারে পৌঁছে দিবে।

 

সে কহে বিস্তর মিছা,

যে কহে বিস্তর।

মূলভাব : যে ব্যক্তি বেশি কাজ করে তার কাজের মধ্যে যেমন ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তেমনি যে ব্যক্তি বেশি কথা বলে তার কথার মধ্যেও ভুল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। 

সম্প্রসারিত ভাব : মানুষ কথার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে। ভাব প্রকাশের অন্যতম বাহনই হলো ভাষা বা কথা। এ কথার মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনে মানুষ তার চাহিদার প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকে। কিন্তু এ কথায় এক সময় ‘কথার কথাতে পরিণত হয়, আবার অন্য সময় অকথা হিসাবে প্রাণ পায়।’ বাস্তব জীবনে লক্ষ করলে দেখা যায়, সমাজে যে সব শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী এবং জ্ঞানী লোক আছে তারা প্রত্যেকেই কম কথা বলেন। কম কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘যতটা না পড়বে তার চেয়ে অধিক বেশি চিন্তা করবে।’ কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে তার সুফল পাওয়া যায় কিন্তু কথা অনুযায়ী কাজ না করলে সে কথাটিই আবার অকথায় পরিণত হয়। পরিমিত কথার মধ্যে বাস্তবতার পরিচয় বহন করে। কিন্তু এ কথাকেই দীর্ঘায়িত ও শ্রুতিমধুর করে উপস্থাপন করতে গিয়ে কথার মৌলিকতা হারিয়ে ফেলে এবং মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। 


স্বার্থক জনম আমার জন্মেছি এ দেশে 

স্বার্থক জনম মা গো, তোমায় ভালোবেসে। 

মূলভাব : জন্মভূমির প্রতি টান, হৃদয়ের টান। তাতে আছে আত্মিক বন্ধন। এ জননী সদৃশ্য জন্মভূমি সম্বন্ধে আমাদের দেশের প্রাচীন সাহিত্যে বলেছে- ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী।’ এই কালের কবি রবীন্দ্রনাথও বলেছেন : 

                                                        ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা 

                                                      তোমাতে বিশ্বময়ীর তোমাতে বিশ্ব মায়ের আঁচল পাতা।’ 

সম্প্রসারিত ভাব : জননী আমাদের জন্মযাত্রী ও ধাত্রী। নিজের জীবন তুচ্ছ করে অসহনীয় কষ্ট সয়ে তিনি আমাদের পৃথিবীর আলো দেখান। তিনি আমাদের লালন-পালন করেন। জগতের সাথে প্রথম পরিচয়ের সূত্রই তো মা। তার স্নেহধারা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করি। জননীর মত জন্মভূমিও আমাদের বরণীয় ও পূজ্য। জননীর মত অনেক গুণেই তিনি আমাদের জীবন সিক্ত করেন। ভূমিষ্ঠের পর চোখ মেলে যে দেশ দেখলাম, যে দেশ দিল আলো, যে দেশের বাতাস বুক ভরে নিলাম, যে দেশ নিবৃত্ত করল ক্ষুধা ও তৃষ্ণা, দিল লজ্জা নিবারণের বস্ত্র সে দেশ তো শুধু নিছক ভূখণ্ড নয় -এতো আর এক মা -আমাদের জন্মভূমি। স্বদেশের মানুষ, স্বদেশের রূপবৈচিত্র্য, স্বদেশের পশুপাখি, স্বদেশের গাছপালা, স্বদেশের ধূলিকণা তাই তার সন্তানের কাছে আপন, পরম প্রিয়। নিজের দেশের কাছে, জন্মভূমির কাছে প্রতিটি মানুষ আজন্ম ঋণী। যে দেশে সে জন্মেছে, যার ‘চিন্ময়ী মূর্তির চির অধিষ্ঠান’ তার আশা-ভালোবাসার মোড়কে তাকে সে সেবায়, দশের মঙ্গল কামনায় ও আত্মোৎসর্গে সার্থক করে তোলে। 

এ মানবিক গুণে জন্মভূমি হয়ে উঠে জননী। স্বর্গ অলীক কল্পনা হলেও জননী ও জন্মভূমি আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিষয়। তাই আমাদের কাছে স্বর্গের চেয়ে জন্মভূমি অধিকতর বরণীয়া ও আকর্ষণীয়া।

সাহিত্য জাতির দর্পণস্বরূপ

মূলভাব : সাহিত্যের মাধ্যমে কোন জাতির ধ্যান-ধারনা, চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটে। একটি দেশের সামগ্রিক পরিচয় ফুটে উঠে সেই দেশের সাহিত্যে। 

সম্প্রসারিত ভাব : সাহিত্যের সাথে মানব জাতির ও সমাজের যোগাযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ। জীবন ও সমাজকে নিয়েই সাহিত্য। কবি সাহিত্যিকেরা সমাজের মানুষ। সমাজ জীবনের লদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে সাহিত্য রচিত হয়। সে জন্য সাহিত্যে সমাজ জীবনের প্রতিফলন ঘটে। সাহিত্যের এ বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে সাহিত্যকে সমাজের দর্পন বলে অভিহিত করা হয়। 

সাহিত্য সমাজকে নিয়ে সমাজের মানুষের জন্য সমাজের মানুষ দিয়ে তৈরী। লেখকেরা তাঁদের চারপাশের জীবন থেকে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেন তা তাঁদের লেখায় প্রকাশ করেন। চারদিকে তাঁরা যা দেখেন, যা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন তার সাথে মনের কল্পনা মাধুরী মিশিয়ে রচিত হয় সাহিত্য। সেজন্য সাহিত্য রচনার মূল উপকরণ মানুষের জীবন তথা সমাজ। লেখকেরা সমাজেরই অধিবাসী। তাঁরা লেখেন মানুষের জন্য। তাঁরা উপকরণ সংগ্রহ করে সমাজের জীবনধারা থেকে। সে জন্য সাহিত্যের মধ্যে যে জীবন বিধৃত হয় তা সমাজের মানুষের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার জীবন। সাহিত্য পাঠ করে এ সমাজ জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। এদিক থেকে সাহিত্য সমাজ জীবনের তথা জাতির দর্পণ। সমাজের মানুষ সাহিত্যের মাধ্যমে নিজের জীবনের প্রতিফলন লক্ষ্য করে। সাহিত্যে জীবনের এ প্রতিফলন ঘটেছে বলে মানুষের কাছে যুগ যুগ ধরে তা সমাদৃত এবং জীবনকে বৈচিত্র্যময় রূপে প্রত্যক্ষ করার উৎস হিসেবে বিবেচিত।

কোন জাতির প্রতিনিধিত্ব করে সেই জাতির সাহিত্য। পৃথিবীতে যে জাতির সাহিত্য যত বেশি উন্নত, জাতি হিসেবেও সে জাতি তত বেশি উন্নত।

 

সঞ্চয়ই উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি 

মূলভাব : সঞ্চয় হল সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। ক্ষুদ্র সঞ্চয় থেকে বৃহৎ পুঁজি অর্জিত হয়। ব্যক্তি সঞ্চয় থেকে রাষ্ট্রীয় সঞ্চয়ের উৎস তৈরি করে। তাই সঞ্চয়ী মনোভাব সমৃদ্ধ জাতি ধীরে ধীরে উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করতে পারে। 

সম্প্রসারিত ভাব : ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা এবং বিন্দু বিন্দু জল থেকেই মহাদেশ এবং মহাসমুদ্রের সৃষ্টি। মৌমাছি এবং পিঁপীলিকা সঞ্চয়ী মনোভাবের কীটপতঙ্গ। তবুও তারা সঞ্চয়ী হওয়ায় বিরূপ পরিবেশে আজও টিকে আছে। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ হিসেবে আমাদের টিকে থাকতে হলেও সঞ্চয়ী অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীর উন্নত জাতিগুলো তাদের সঞ্চয়ী মনোভাবের জন্যই উন্নতির স্বর্ণশিখরে উঠতে পেরেছে। তাই শৈশবকাল থেকেই সঞ্চয়ী হওয়ার অভ্যাস গঠন করতে হয়। প্রত্যেক ধর্মেই মিতব্যায়ী বা সঞ্চয়ী হওয়ার অভ্যাস গঠনের কথা বলা হয়েছে। কেননা, সুদিনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় আমাদের দুর্দিনে মহান আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। জাতিগতভাবে সঞ্চয়ী সম্পদ রাষ্ট্রীয় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সহায়ক ভূমিকা রাখে। 

তাই ব্যক্তি, গোষ্ঠী তথা দেশের মঙ্গলের জন্য আমাদের সবাইকে সঞ্চয়ী হওয়া উচিত। তবেই সুখ ও সমৃদ্ধি আমাদের কাছে সোনার হরিণ হয়ে দেখা দিতে বাধ্য এবং উন্নত জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে আমরা ঠাঁই পাবো।

সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত

অথবা,

জ্ঞানশক্তি অর্জনিই শিক্ষার উদ্দেশ্য

মূলভাব : শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত হলেই তাকে শিক্ষিত বলা যাবে না। সুশিক্ষিত হতে হলে তার মধ্যে সৃজনশীল অনুভূতি থাকা প্রয়োজন। 

সম্প্রসারিত ভাব : শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ শিক্ষিত হয়ে উঠে। মানব জীবন সুগঠন ও সুন্দর বিকাশের জন্য শিক্ষা একটি অপরিহার্য বিষয়। শিক্ষা ব্যবস্থার অবকাঠামোর ভিতর দিয়ে শিক্ষা অর্জনের রীতি প্রচলিত রয়েছে। আর এ শিক্ষা অর্জন করেই শিক্ষিত মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে শিক্ষা অর্জিত হলেও শিক্ষার সীমা সেখানে শেষ হয়ে যায় না। শিক্ষার পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হতে হলে মানুষকে নিজস্ব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হয়। স্বশিক্ষা বা নিজে নিজে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হয় বেশি জ্ঞানের জন্য। শিক্ষা লাভের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ধাপে ধাপে এগিয়ে শিক্ষার্থীরা সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি অর্জন করে এবং শিক্ষিত হিসেবে পরিচিত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। নির্দিষ্ট ডিগ্রি প্রধানের মধ্যেই তার দায়িত্ব শেষ হয়। কিন্তু শিক্ষার পরিধি অনেক বড়। সেই বিশাল পরিধির বিষয়কে কোন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। জ্ঞানের রাজ্য অসীম এবং তা বাঁধাধরা পাঠ্যসূচির মাধ্যমে আয়ত্ব করা চলে না। সে জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে লোক শিক্ষিত নামে পরিচিত হয়। কিন্তু জ্ঞান রাজ্যে বিচরণ করে ব্যাপক শিক্ষা অর্জন করা যায় তা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় সম্ভব নয়। শিক্ষিত লোককে আরও বেশি শিক্ষার জন্য জ্ঞানের রাজ্যে মুক্তভাবে বিচরণ করতে হয়। নিজের উদ্যেগে শিক্ষা অর্জন করে শিক্ষিত ব্যক্তি আরও বেশি শিক্ষিত হয়ে ওঠে। বলা হয়ে থাকে, ‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পরই প্রকৃত শিক্ষা আরম্ভ হয়।’ যথার্থ জ্ঞান অর্জনের জন্য নিজের চেষ্টায় জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করতে হয়। সুশিক্ষার জন্য নিজের উদ্যেগের প্রয়োজন। স্বশিক্ষার মাধ্যমে সুশিক্ষিত হয়ে ওটা সম্ভব। সে জন্য সারা জীবন ধরে মানুষের জ্ঞান সাধনা চলে। নিজের চেষ্টা-চেতনা এবং অনুশীলনের দ্বারা স্ব-শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব। এটা কোন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জন করা যায় না। এভাবে যারা শিক্ষা অর্জন করে তারাই কেবল প্রকৃত শিক্ষিত।

            শিক্ষার মত পরম পাথর আর নেই 

মূলভাব : শিক্ষা মানুষকে মহৎ করে তোলে। পরশ পাথরের স্পর্শে লোহা যেমন খাঁটি সোনায় পরিণত হয় তেমনি শিক্ষার ভেতর দিয়ে মানব জীবন সার্থক হয়ে উঠে। 

সম্প্রসারিত ভাব : শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের প্রকৃত পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়। শিক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষের মনুষ্যত্ব প্রকাশ পায়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের উন্মেষ ঘটিয়ে তার সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করা। এর ফলে মানুষ আত্ম আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও সামগ্রিক ক্ষেত্রে নিজের অবস্থানকে চিহ্নিত করতে পারে। একই সাথে সৃষ্টিশীল প্রতিভা সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিয়মতান্ত্রিক অগ্রগতির পক্ষে উত্তরণ ঘটিয়ে দেয়। অপরদিকে শিক্ষাহীনতা মানুষকে কুসংস্কার ও অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করে। শিক্ষাহীন মানুষ যেমন ব্যক্তি জীবনে, তেমনি জাতীয় ক্ষেত্রে কোন অবদান রাখতে পারে না। শিক্ষাহীনতার জন্যই জাতীয় অগ্রগতি হয়ে পড়ে পঙ্গু ও বন্ধ্যা। শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ডের সাথে তুলনা করা হয়। মেরুদণ্ড মানবদেহের অপরিহার্য অঙ্গ। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন মানুষ চলতে পারে না, তাকে অন্যের গলগ্রহ হয়ে জীবন যাপন করতে হয় তেমনি অশিক্ষিত জাতিকে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে টিকে থাকতে হয়। মানুষের জীবনে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আমাদের চারদিকে আমরা সর্বত্র শক্তির লীলা প্রত্যক্ষ করি। শিক্ষার সাহায্যেই মানুষ সে শক্তি করায়ত্ত করে। পশু-পাখি আপনাকে চিনে না। কিন্তু মানুষ শিক্ষা ও জ্ঞানের দ্বারা অন্যান্য প্রাণীর উপর প্রভুত্ব করতে সমর্থ হয়েছে। শিক্ষা অমূল্য ধন এবং মানব জীবনের এ অপরিহার্য বিদ্যাই মানুষের জ্ঞান চক্ষুকে উন্মোচিত করে প্রকৃতির অফুরন্ত রত্নরাজির সন্ধান দেয়। যে জীবন শিক্ষার পরশ পায় না, সে জীবন অন্ধের শামিল। কারণ পৃথিবীর জ্ঞান ভাণ্ডার তার নিকট অজ্ঞাত থাকে। চোখ থাকা সত্ত্বেও বিদ্যার অভাদে পৃথিবীর সম্পদরাশির সৌন্দর্য সুষমার সন্ধান সে পায় না। ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের আলোয় আলোকিত নয় বলে পদে পদে সে অন্ধকার দেখে। অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত জনগোষ্ঠী তাই জাতির জন্য বোঝাস্বরূপ। ‘নিশ্চল জীবনপঙ্গে’ রুদ্ধ এ মানুষেরা যতদিন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকবে জাতির দুর্ভাগ্য ততই প্রবল হবে। এ দুঃস্থ মানুষেরা নিজেরাই মানবেতর জীবন যাপন করবে সেই সাথে জাতির অগ্রগতির পথে পথে দুর্লঙ্ঘ বাধা সৃষ্টি করবে।বস্তুত, শিক্ষার প্রসারই পারে সব কুসংস্কার, জড়তা দূর করে জাতিকে গতিশীল করতে, সমস্যার মোকাবেলায় সক্ষম করে তুলতে, আশা ও স্বপ্ন দেখার সাহস যোগাতে। তাই শিক্ষাকে পরশ পাথরের সাথে তুলনা করা হয়।


যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা

মূলভাব : যুদ্ধ মানে প্রলয়, যুদ্ধ মানে ধ্বংস। ক্রোধ, লোভ, ক্ষমতার দম্ভ প্রভৃতির বশবর্তী হয়ে মানুষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠে। বস্তুত যুদ্ধ যেন শত্রুর সাথে শত্রুর খেলা। 

সম্প্রসারিত ভাব : মানুষকে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে মানুষ নানাভাবে টিকে থাকার জন্য যুদ্ধ করে আসছে। কিন্তু টিকে থাকার জন্য আদিকালের সেই যুদ্ধ আর আজকের সুসভ্য মানুষের অসভ্য বর্বরোচিত প্রতিহিংসা, লোভ, ক্ষমতার দম্ভ বহিঃপ্রকাশের যুদ্ধ এক নয়। তখন মানুষ যুদ্ধ করত পশুর সাথে আর এখন মানুষ যুদ্ধ করে মানুষের সাথে। ভাইয়ে-ভাইয়ে, গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে, দেশে-দেশে, জাতিতে-জাতিতে আজ অহরহ যুদ্ধ। যুদ্ধ ছাড়া যেন মানুষ স্থির হতে পারছে না। এমন কোন দিন নেই, যেদিনটিতে দু’চার’টি দেশে যুদ্ধ হচ্ছে না, দু চার লাখ মানুষের শোণিতে ধরাতল রঞ্জিত হচ্ছে না। অথচ যারা যুদ্ধের চাবিকাঠি নাড়ে তাদের কাছে যেন সেটা পুতুল খেলার মত। তারা যেন শত্রুতে শত্রুতে খেলা করে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা আমরা জানি। আধুনিক যুদ্ধের ভয়াবহতাও আমরা ভালো করেই বুঝি। কিন্তু তারপরও আমাদের ক্ষমতা লিপ্সুদের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব কাটেনি। অন্যের অধিকার খর্ব করার জন্য আমাদের শাসকগোষ্ঠী সদা সাজোয়ান। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই আমরা যার জ্বলন্ত প্রমাণ পেলাম ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন হামলার মধ্য দিয়ে। এ তো ক’দিন আগে শক্তিধর ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর কাছে হেরে গেল স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন। স্বাধীনতা হারাল ইরাক পরিণত হল ইঙ্গ-মার্কিনীদের আধুনিক কালোনীতে। প্রাণ হারালো অসংখ্য নিরীহ মানুষ। ইরাকিদের রক্তের দাগ এখনও মাটি সম্পূর্ণ শুষে নিতে পারিনি। আজও রক্ত ঝরছেই সেখানে। অথচ যুদ্ধের হোতা জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং টনি ব্লেয়ার হেসে-খেলেই দেখছেন সে দৃশ্য। শত্রু অজুহাতে সাদ্দামকে তারা শক্তি দিয়ে কব্জা করেছেন। তারা যখন খুশি যাকে খুশি আক্রমণের হুমকি দিচ্ছেন। বস্তুত সারা বিশ্বে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো যেন তাদের খেলার পাত্র, সারা বিশ্বের নিরীহ মানুষগুলোর রক্তখেলা যেন তাদের প্রমোদের বিষয়। আর সে কারণেই বলা হয়েছে যে, যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা। যুদ্ধ হচ্ছে যোদ্ধাদের খেয়ালীপনা, শত্রু শত্রু খেলা। যার শিকার হয় অধিকাংশ সাধারণ মানুষ।

কুকুরের কাজ কুকুরে করেছে কামড় দিয়েছে পায়।

তা বলে কুকুরে কামড়ানো কি মানুষের শোভা পায়।

মূলভাব : কুকুর নিম্নশ্রেণীর জীব। তার কাজ শত্ৰুবোধে প্রাণী নির্বিশেষে কামড়ানো। হিংসার বশে, প্রতিহিংসা চরিতার্থে কুকুর তেড়ে গিয়ে যেমন কামড়াকামড়ি করতে পারে বিবেকসম্পন্ন মানুষ তা পারে না। প্রকৃতিগত পার্থক্যেই শুধু নয় বিবেকের পার্থক্যেই নিম্নশ্রেণীর প্রাণী কুকুরের চেয়ে মানুষ শ্রেষ্ঠ, আবার স্বার্থপর মানুষের থেকে বিবেকসম্পন্ন স্বার্থশূন্য মানুষ শ্রেষ্ঠ।

সম্প্রসারিত-ভাব : এ পৃথিবীতে কুকুরের মত নিম্নশ্রেণীর এক ধরনের মানুষ আছে। যারা উপকারীর উপকার স্বীকার করে না। আপন স্বার্থ সবসময় আগলিয়ে রাখে। এমনকি আঘাত আসার আশঙ্কায় সর্বদাই অন্যকে আঘাত হেনে চলে। এরা প্রবৃত্তিতে নিম্ন, মনুষ্যত্বে খাট। প্রতিহিংসা এবং অন্যায়ের পথ ধরে চলে বলেই এদের পরিণাম ভয়াবহ। সাধককে যারা সাধনার পথ থেকে সরাতে উদ্যত, জ্ঞানী ও গুণীজনদের যারা অপমান করে তাদের বংশ গৌরব যতই থাকুক মনুষ্যত্ব নিশ্চয়ই থাকে না। পক্ষান্তরে, এ জগতে আর এক শ্রেণীর মানুষ আছেন যারা জ্ঞানী ও গুণীজনদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দেন, আপন সম্পদ দেশ ও দশের কল্যাণে নিয়োজিত রাখেন, সকলের সাথে ভাগ করে খান আহার্য, এরাই প্রকৃত মানুষ। পৃথিবী এদের গর্ভে ধারণ করে গর্বিত। আঘাতে জর্জরিত হলেও এরা কখনও প্রত্যাঘাত করতে চায় না।

তাই সত্য ও সুন্দরের পূজারী এসব মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে অল্প। কিন্তু এরা যদি না থাকত তাহলে মানুষ মনুষ্যত্ব হারাত, পৃথিবী ভরে উঠত কুকুরের মত নিম্নশ্রেণীর জীবে।

 

কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর

 ,

মানুষ পার্থিব জগতের বাইরেও মৃত্যুর পরে এক নতুন জগৎ কল্পনা করে। যা স্বর্গ ও নরকের সমন্বয়ে গঠিত। ধর্মীয় চিন্তা থেকে মানুষ পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়ের হিসাব করে থাকে। আর এই অনুভূতি থেকেই স্বর্গ ও নরক লাভের কথা ভাবে। নরক একটি ভয়ংকর জায়গা যেখানে শাস্তি দেয়া হয়। আর স্বর্গ হচ্ছে অনাবিল সুখ-শান্তির জায়গা। মানুষ পৃথিবীতে কৃতকর্ম অনুসারে স্বর্গ ও নরকে জায়গা করে নিবে। যারা ভালো কাজ করবে তারা স্বর্গে বাস করবে। আর যারা খারাপ কাজ করবে তারা নরকে বাস করবে। মূলত এই স্বর্গ-নরক আর কিছুই নয়, এটা মানুষের কর্মফলের উপর নির্ভর করে। মানুষের প্রতিদিনকার কাজের মাঝেই স্বর্গ-নরক বিরাজমান। লোভ-লালসা, ঝগড়া-বিবাদ, হিংসা মানুষকে পশুতে পরিণত করে। ফলে সে ন্যায় অন্যায়ের সীমারেখা ভুলে যায়। নিজেকে নানা রকম খারাপ কাজে জড়িয়ে ফেলে। আর এসব কারণেই সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। পৃথিবীতে নেমে আসে এক নরক যন্ত্রণা। এ সকল যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মানুষকে অন্যায় ছেড়ে ন্যায়ের পথে আসতে হবে। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা, সৌহার্দ্য গড়ে তুলতে হবে। একে অন্যের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। অন্যের কল্যাণ সাধনের জন্য সর্বদা চেষ্টা করতে হবে। এমন কোনো কাজ করা যাবে না যাতে অন্যের ক্ষতি হয়। সকলে যদি সৎ ও ন্যায়ের পথ অবলম্বন করে, তাহলেই কেবল এ পৃথিবীতে স্বর্গীয় সুখ লাভ করা সম্ভব।

শিক্ষা: স্বর্গ ও নরক পৃথিবীর বাইরের কিছু নয়। মানুষের ভালো কাজ এবং আচরণের মাঝেই স্বর্গ থাকে এবং খারাপ কাজের মাঝে থাকে নরক।

কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই বলে ডাক যদি দেব গলা টিপে, হেন কালে আকাশেতে উঠিলেন চাঁদা, কেরোসিন শিখা বলে- “এসো মোর দাদা।”

 ,

মানুষ ভেদে চরিত্রে পার্থক্য থাকলেও পৃথিবীর সব মানুষের চরিত্র কিছু বৈশিষ্ট্যে সাদৃশ্যপূর্ণ। মানব চরিত্রের তেমনি একটি বৈশিষ্ট্যকে কেরোসিন শিখার মাধ্যমে রূপায়ণ করা হয়েছে। অর্থঃ -বিত্ত, সামাজিক পদমর্যাদা ইত্যাদির স্বপ্নে বিভোর হয়ে কখনও কখনও নিজের অতি আপনজনকেও চিনতে পারে না। মানুষ যখন টাকা-পয়সা, পদমর্যাদা প্রভৃতি দিক থেকে সমাজে উচ্চ অবস্থান অর্জন করে তখন সে তার আপন মানুষজন আত্মীয় স্বজনকে অবহেলা করে। অবহেলাই কোনো কোনো সময় অস্বীকারে রূপ নেয়। মানুষ যখন চিন্তা করে তার দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক রাখলে তার পদমর্যাদা নষ্ট হতে পারে তখন তার দরিদ্র আপনজনদের আর স্বীকৃতি দিতে চায় না। অথচ এই মানুষটিই আবার তার চেয়ে উচ্চ পদস্থ কারও তোষামোদ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। সেই উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির সাথে সত্যিকার অর্থঃ ে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও সে কাল্পনিক সম্পর্ক তৈরি করেই তা সবাইকে জানাতে চায়। সে মনে করে এতে সে সামাজিকভাবে আরও মর্যাদা পাবে, এবং অন্যরা তাকে আরও সমাদর করবে। এভাবে সে নিজেকে প্রচার করে গর্ববোধ করে। যেখানে নিজের দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনদের যে স্বীকার করতেও কুন্ঠাবোধ করে সেখানে দূরের একজন উচ্চ-পদস্থ ব্যক্তির সাথে সে জোর করে কাল্পনিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে। মূলত মানুষ নিজের চেয়ে অবস্থানে ছোটদের চরমভাবে অস্বীকার করে, আর বড়দের তোষামদ করে আপন করে নিতে চায়।

শিক্ষা: পদমর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান মানুষকে অন্ধ করে দেয়। এর প্রলোভনে মানুষ নিজের আপন মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়ে, দূরের মানুষকে আপন করার চেষ্টা করে। এতে করে সে তার নিজস্বতাকে হারিয়ে ফেলে, কিছুই অর্জন করতে পারে না।

 

পরিশেষেঃ

 সার্ভার সমস্যার কারণে  ভিজিট করতে অনেক কষ্ট হয়ে পরে তাই সর্বাধিক চেষ্টা করছি ভালো কিছু তুলে ধরতে এবং  এই সাইট যে সকল পোস্ট করা হয় সে সকল পোস্ট কোন প্রকার প্রতারিত করার  উদ্দেশ্য নহে।এ পোস্ট গুলি আপনাদের ভালোলাগার জাইগা দখল করলে লাগলে সাইট এ visit করতে ভুলবেন না কিন্তু | আপনাদের জন্যই পোস্ট করে থাকি আপনারা যাতে সহজ ভাবে খুঁজে নিতে পারেন এ জন্যই সর্বাধিক চেষ্টা করে যাচ্ছি |যথেষ্ট ধৈর্য্য সহ আমাদের পোস্ট পড়ার জন্য ও আমাদের সাথে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অশেষ  ধন্যবাদ ।


ssc bangla 2nd paper, class 7 bangla 2nd paper book, class 8 bangla 2nd paper book, bangla 2nd paper book,class 9 bangla second paper book,